একটি ভাল ব্যাগ কার না ব্যবহার করতে ভাল লাগে সে ছেলে হোক আর মেয়েই হোক। আমরা যে ব্যাগ ব্যবহার করি এই ব্যাগ গুলো লেদার বা চামড়া দিয়ে তৈরি। লেদার বা চামড়া বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। তাহলে চলুন লেদার সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই।
ব্যাগ গুলো তে যে লেদার বা চামড়া ব্যবহার করা হয় অর্থাৎ চামড়াকে বিলাস বহুল উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। সেই কারণে পৃথিবী তথা পুরো বিশ্বে লেদারের উচ্চ মূল্যে হিসেবে মার্কেট এ স্থান করে নিয়েছে।প্রায় ৪ হাজার বছর ধরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ চলছে যেমন: Clothing, Automobile, Footwear, Home-furnishings ইত্যাদিতে। জবাইকৃত পশু থেকে চামড়া সংগ্রহ করে প্রাকৃতিক ভাবে প্রক্রিয়াজাত করে লেদার শিল্প বিশ্ববাজারের চাহিদা মেটাত। কিন্তু দেখা গেল বিশ্ববাজারে এর চাহিদা আরও ব্যাপক ।এ জন্য আরও বেশি পশু জবাই করা হতো চামড়া সংগ্রহ করতে। কিন্তু লক্ষ লক্ষ প্রানীর জবাইয়ের ফলে জীববৈচিত্র্য এ ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলত। যা আমাদের পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ।
তাই এর বিকল্প হিসেবে সিন্থেটিক চামড়া প্রাকৃতিক চামড়ার বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হতো। পলিউরেথেন এবং পলিভিনাইল ক্লোরাইড সিন্থেটিক চামড়ার গাঠনিক আকারের জন্য ব্যবহার করা হতো। ভেগান চামড়া নামক একধরনের উপকরণ রয়েছে তা সিন্থেটিক চামড়াতে ব্যবহার করা হতো। ভেগান চামড়া নামক উপকরণটি ব্যবহার করার ফলে প্রাকৃতিক চামড়ার থেকে পরিবেশ বান্ধব হলেও প্রকৃতিতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলত।সিন্থেটিক চামড়া উৎপাদনের সময় পলিভিনাইল ক্লোরাইড নামক যে উপকরণটি ব্যবহার করা হতো সেখানে “ডাইঅক্সিন” নামক কার্সিনোজেনিক উপজাতগুলি উৎপাদিত হত যা আমাদের মানবকুল এবং প্রাণী উভয়ের জন্যই বিষাক্ত। উল্লেখ্য যে এগুলো খাঁটি লেদারের মত নিশ্বেষ হত না এর ফলে পানি ও মাটির সাথে মিশে পরিবেশের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলত তা আমাদের ত্বকের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলত।
এমতাবস্থায় গবেষকরা চিন্তা করল পরিবেশবান্ধব এবং বায়ো-ডিগ্রেডেবল করার জন্য বিকল্প হিসেবে সিন্থেটিক চামড়ার উপকরণ হিসেবে আনারস পাতা, আপেলের খোসা, ভুট্টা, কাঁচা কাটা পিয়ার ক্যাকটাস, মাশরুম, নারকেল, আঙ্গুরের পোমাস ইত্যাদি টেকসই উপকরণ থেকে চামড়া তৈরি করে এর উন্নত টেকসই এবং পরিবেশ বান্ধব হিসেবে বিশ্ববাজারে এর চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে।
তাহলে চলুন এখন জেনে নেওয়া যাক চামড়া শিল্পে ভিবিন্ন প্রকারের যে উপকরণ গুলো ব্যবহার করা হয় সেগুলো এক নজরে দেখে নেই।
১। পিনেটেক্স চামড়া।
২। মুসকিন চামড়া।
৩। আপেল খোসা চামড়া।
৪। ক্যাকটাস চামড়া।
৫। ফুলের চামড়া।
৬। কর্ন চামড়া।
৭। মালাই চামড়া।
৮। ওয়াইন চামড়া।
উপরোক্ত চামড়া গুলো সম্পর্কে নিম্নে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো।
১। পিনেটেক্স চামড়া: আমরা যদি প্রাকৃতিক চামড়ার বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করি তাহলে এই পিনেটেক্স চামড়া ব্যবহার করতে পারি। এটি তৈরি করা হয় আনারস থেকে। ১ বর্গমিটার পিনেটেক্স চামড়া তৈরি করতে ১৬ টির মত আনারস লাগে। উক্ত চামড়া তৈরি করতে আনারসের পাতা সংগ্রহ করা হয় কেননা সেলুলোজযুক্ত পাতার মাধ্যমে চামড়া তৈরি করা হয়। যান্ত্রিক, তাপীয় এবং রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেলুলোজযুক্ত পাতার তন্তু গুলো কে একত্রিত করে ফাইবারের জাল গঠন করে তন্তুগুলিকে একটি প্রতিরক্ষামূলক আবরণ দেওয়া হয়। এভাবেই পিনেটেক্স চামড়া তৈরি করা হয়।
২। মুসকিন চামড়া: এটি হচ্ছে লেদারের মতই যা মাশরুম এর উপরের অংশ টুপি বা ছাতার মতো দেখতে ঐই অংশ টুকু থেকে এই ধরনের চামড়া তৈরি করা হয়।মুসকিন চামড়া মাশরুম ছাড়া অন্য কোন প্রজাতি থেকে তৈরি করা যায় না। মুসকিন চামড়ার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে রয়েছে জল-বিদ্বেষক, অ-বিষাক্ত তাই এই ধরনের চামড়ার মাধ্যমে ফ্যাশন আইটেমগুলি তৈরি করলে যথেষ্ট টেকসই হয় । যেহেতু ছত্রাকের তৈরি স্নিকার্সকে মাশরুমের চামড়া তৈরি করে এর ফলে শীর্ষ বিক্রয় মূলধারার ব্র্যান্ডের মতো নাইক বা ভ্যানের মতো বিবেচনা করা হয়।
৩। আপেল খোসা চামড়া: যেসব শিল্পে জুস তৈরি করা হয় অর্থাৎ জুসিং শিল্পে ভিবিন্ন ফলের খোসা ছাড়ানোর ফলে শিল্পগুলিতে যে বর্জ্য তৈরি হয় এটি একটি চ্যালেঞ্জযোগ্য কাজ। আপেল জুসিং শিল্পে উৎপাদিত বর্জ্যগুলির মধ্যে একটি হল আপেল খোসা যা পরিবেশ দূষণ করে থাকে। পরিবেশের দূষণের কথা চিন্তা করে এসব অপদ্রব্যকে কাজে লাগিয়ে ভেগান জুতার সংস্থা “বীরাহ” আপেল জুসিং শিল্প থেকে 50 শতাংশ আপেল খোসার বর্জ্য বাকী এবং 50 শতাংশ পলিউরেথেনের পাদুকা ব্যবহার পলিউরেথেনের সাথে মিশ্রিত হয়ে চামড়ার মতো ফ্যাব্রিক হয়ে যায়।যা লেদার শিল্পে ব্যাপক ভাবে ব্যবহার হচ্ছে।
৪। ক্যাকটাস চামড়া: ক্যাকটাস নামে একধরনের খাবার আছে যা মেক্সিকান প্রধান খাবার হিসেবে পরিচিত।এটি দেখতে নাশপাতি আকারের। জেনে রাখা ভালো যে টেক্সটাইল শিল্পে বিভিন্ন কাপড়কে রং এর জন্য ক্যাকটাস উপাদানকে ব্যবহার করা হয় যার মাধ্যমে কাপড় রঙ্গিন হয়ে থাকে।
মেক্সিকো থেকে দুজন উদ্যোক্তা নোপাল বা কাঁটাচামচা পিয়ার ক্যাকটাস পাতা থেকে টেকসই নিরামিষাশী চামড়া তৈরি করেছেন। ক্যাকটাসের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এরা নমনীয়, টেকসই ,শ্বাস-প্রশ্বাসে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না। এর ফলে এটি সত্যিকারের চামড়ার মতোই বিবেচনা করা হয়। এছাড়াও এটি আসবাব এবং অটোমোবাইলের মতো কয়েকটি শিল্পে ব্যবহার করা নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলছে।
৫। ফুলের চামড়া: ভারত-ভিত্তিক একটি সংস্থা যা কানপুর ফ্লাওয়ার সাইক্লিং নামে পরিচিত । উক্ত সংস্থা উদ্ভিদ-ভিত্তিক চামড়া তৈরি করেছে যার নাম “ফ্লাথার”। ফ্লিদার তৈরির জন্য উক্ত সংস্থাটি বর্জ্য ফুল সংগ্রহ করে নন-বায়োডেগ্রিডেবল বর্জ্য যেমন প্লাস্টিক এবং থ্রেড থেকে আগাছা পরিষ্কার করে তারপরে গোলাপ, মোগড়া এবং গাঁদা জাতীয় প্রজাতি গুলো বাছাই করা হয়। এরপর বাছাকৃত ফুলগুলি থেকে পাপড়ি গুলোকে ভাঙা হয়। এরপর সবুজ অংশ পরিলক্ষিত হয় যা কম্পোস্টিংয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। বাকী পাপড়িগুলো চামড়া তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয়। উল্লেখ্য যে ফ্যাশন সেরা উদ্ভাবনের জন্য ফ্লিদার একটি ইউএন টেকসই পুরষ্কার এবং একটি ইন্ডিয়া পুরস্কারের খেতাব অর্জন করতে সক্ষম হয়।
৬। কর্ন চামড়া: “ভেজা” নামে ফ্রেঞ্চ ফুটওয়্যার ব্র্যান্ড মোম থেকে ক্যাম্পো জুতা তৈরি করতে সক্ষম হয় যা খাদ্য শিল্পের 50 শতাংশ কর্ন বর্জ্য থেকে তৈরি এবং পলিওরেথেনের সাথে মিশ্রিত। এটি স্পর্শ এবং স্থিতিস্থাপক বিশিষ্ট যা কর্ন চামড়ার একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য বহন করে।
৭। মালাই চামড়া: এটি নারিকেলের ভেতর যে পানি থাকে ঐই পানি দিয়ে মালাই চামড়া তৈরি করা হয়।এটি সম্পূর্ণরূপে জৈব এবং টেকসই ব্যাকটেরিয়া সেলুলোজ থেকে নতুন বায়ো কমপোজাইট উপাদান যা দক্ষিণ ভারতে নারকেল শিল্প থেকে উৎপন্ন কৃষি বর্জ্যে জন্মে থাকে। উক্ত কাঁচামাল জীবাণুমুক্ত করার পরে গাঁজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেলুলোজকে পরিশুদ্ধ করা হয় এবং অবশেষে প্রাকৃতিক তন্তু দিয়ে আরও শক্তিশালী করা হয়।এর মাধ্যমে মালাই চামড়া তৈরি করা হয়।
৮। ওয়াইন চামড়া: ইতালিয়ান সংস্থা “Vegea Company” ওয়াইন শিল্প থেকে ভেজান নামক চামড়া উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়। যেই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী, প্রতি বছর 26 বিলিয়ন লিটার ওয়াইন উৎপাদিত হয় এবং প্রায় 7 বিলিয়ন কিলোগ্রাম আঙ্গুরের ছোলা অর্থাৎ বর্জ্য হিসাবে উৎপাদিত হয়। উক্ত সংস্থা এই বর্জ্যগুলিকে কাজে লাগিয়ে একটি পরিবেশগত পদার্থ, ওয়াইন লেদারে রূপান্তরিত করেছে। উক্ত ওয়াইন চামড়ার চামড়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য বহন করে যান্ত্রিক, নান্দনিক এবং সংবেদনশীল।
✒️ Writer information:
Aslam Ahmed
Primeasia University
Batch: 193
Campus Core Team Member (TES)