Friday, May 2, 2025
Magazine
More
    HomeBTMA, BGMEA & BKMEAপোশাক শিল্পে শ্রমিকদের সংগ্রাম ও সম্ভাবনা প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

    পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের সংগ্রাম ও সম্ভাবনা প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

    বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্প। দেশের মোট রপ্তানি আয়ে এ খাতের অবদান ৮১% এবং জিডিপিতে এ খাতের অবদান ১৬%। এ খাতে উন্নয়নের নেপথ্য নায়ক পোশাক শ্রমিকরা। এ খাতের অগ্রগতির প্রতি পরতে পরতে রয়েছে প্রায় ৫০ লক্ষ শ্রমিকের অমানবিক পরিশ্রম ও বঞ্চনার ইতিহাস। গার্মেন্টস সেক্টরের শত সফলতা আর অর্জনের গল্পের ভীড়ে চাপা পড়ে যায় এসকল শ্রমিকদের মজুরি বৈষম্য, অনিরাপদ কর্মপরিবেশ, শ্রম আইন লঙ্ঘন এবং রাজনৈতিক প্রভাবে পরিবেষ্টিত এই শিল্পের অন্ধকার দিক।


    ন্যায্য মজুরির সংকট
    পোশাক খাতে পৃথিবীর সবচেয়ে কম মজুরি পাওয়া বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকরা [১] , ২০২৩ সালে তেইশ হাজার টাকা মজুরির দাবিতে বিক্ষোভ ও কিছু বিচ্ছিন্ন সহিংসতামূলক কর্মকাণ্ড করেছিলেন। এ সময়ে তাদের বিরুদ্ধে ৩৫টি ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়, যার ফলে প্রায় ৪৪,০০০ শ্রমিক আইনি ঝুঁকিতে পড়েছিলেন।[২]
    তারা কেবল কম মজুরি পান তা নয়। বরং কেয়ার বাংলাদেশ এর এক জরিপে দেখা যায়, ২২ শতাংশের বেশি গার্মেন্টস কারখানায় শ্রমিকরা নিয়োগপত্র পান না। ৪০ শতাংশ শ্রমিক জানে না, সার্ভিস বুকে কি তথ্য রয়েছে এবং সেখানে যে তাদের স্বাক্ষর থাকতে হয়- তাও জানে না। অনেক শ্রমিক স্বেচ্ছায় বা বাধ্যতামূলক ওভারটাইম করে ওভারটাইমের যথাযথ মজুরি পান না।[৩]
    অনেক শ্রমিক প্রতিদিন ১২-১৬ ঘন্টা বা সাপ্তাহে ৮০-১০০ ঘণ্টা কাজ করেন। ৭৮ শতাংশ শ্রমিক সপ্তাহিক ছুটি থেকে বঞ্চিত হন। অন্যদিকে, অর্ডার শিপমেন্ট কিংবা উৎসবের মত পরিস্থিতির কারণে প্রায় ৭৯ শতাংশ শ্রমিক সাপ্তাহিক ছুটি থেকে বঞ্চিত হন [৪] ; যা স্পষ্টত-ই বাংলাদেশ শ্রম আইন – ২০০৬  (Bangladesh Labour Act, 2006) এর লঙ্ঘন। 


    লিঙ্গবৈষম্য ও যৌন হয়রানি
    গার্মেন্টস সেক্টরের কর্মরত ৫০ লক্ষ শ্রমিকের মধ্যে শতকরা ৫৫ জন শ্রমিক জৈবিকভাবে নারী [৫]। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে গ্লোবাল জাস্টিস অর্গানাইজেশনের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ৮০% নারী শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন।[৬]  সুপারভাইজার ও ম্যানেজারদের দ্বারা নারী শ্রমিকদের হয়রানি ও হেনস্তা যেন গার্মেন্টস সেক্টরে সাধারণ ঘটনা [৭]।  
    তবে আশার কথা, যেসব পোশাক কারখানায় অ্যান্টি-হ্যারাসমেন্ট কমিটি রয়েছে, সেসকল কারখানায় এ ধরনের যৌন হয়রানি ৬১ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া বর্তমানে প্রায় ৭৬ শতাংশ নারী শ্রমিক মাতৃত্বকালীন ছুটি ও সুবিধা পাচ্ছেন। [৩]


    অনিরাপদ কর্মপরিবেশ,  দুর্ঘটনা ও স্বাস্থ্যঝুঁকি
    ২০১৩ সালের রানা প্লাজা ধসে ১১৩৪ শ্রমিক নিহত হন। ২০১২ সালের তাজরীন ফ্যাশনস এ আগুনে পুড়ে মারা যান ১১২ জন পোশাক শ্রমিক।[৮]
    এসকল দূর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গার্মেন্টস-সমূহে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা মানদণ্ড নিশ্চিতে দেশি বিদেশি চাপ তৈরি হয়। নানামুখী চাপের প্রেক্ষিতে গার্মেন্টস কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিতে যৎসামান্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ২০১৯ সালে ১৬০০টি কারখানার মধ্যে মাত্র ২০০টি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা মানদণ্ড পূরণ করতে সক্ষম হয়েছিল। শতকরা হিসেবে এটি মাত্র ১২.৫ শতাংশ। [৯]
    এছাড়া সিপিডি-র তথ্যমতে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত মাত্র ২০% কারখানা নিরাপত্তা মানদণ্ড নিশ্চিতে সক্ষম হয়েছে। [১০]


    শ্রমিকদের জীবনমান
    সার্বিক বিবেচনায় এই শ্রমিকরা যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও একেকজন আধুনিক দাসে পরিণত হয়েছেন।
    সাম্প্রতিক সময় নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাইটস ল্যাব এবং গুডওয়েভ ইন্টারন্যাশনাল মিলে তৈরি পোশাক শিল্পে আধুনিক দাসত্ব ও শিশুশ্রমের ঝুঁকি নথিভুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। এই জরিপে গার্মেন্টস সেক্টরে শিশুশ্রমের উপস্থিতি, নারী পোশাক শ্রমিকদের প্রতি বেতন বৈষম্য, কম মজুরি প্রদান এবং পোশাক শ্রমিকদের কর্মস্থলে হুমকি ও নির্যাতনের নিদারুণ চিত্র উঠে এসেছে।  [১১]
    তীব্র কাজের চাপ, অতিরিক্ত পরিশ্রম, কম মুজরি, পুষ্টিকর খাদ্যাভাব, কারখানার অনিরাপদ পরিবেশ শ্রমিকদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের প্রায় ৭৭.১ শতাংশের মধ্যে বিভিন্ন রোগের ও পেশি ব্যথার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।[১২] এছাড়া কর্মক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত সময় দায়িত্ব পালনের ফলে তাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।


    সমাধানের সম্ভাব্য উপায়  
    ১. ন্যায্য মজুরি ও কর্মঘণ্টা নিয়ন্ত্রণ
    ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি করা।  
     শ্রম আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা।  
    ২. নারী ও শিশুশ্রমের অবসান
     মাতৃত্বকালীন সুবিধা নিশ্চিত করা।  
     শিশুশ্রম বন্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা।  
    ৩. নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণ
    ১০০% কারখানায় ফায়ার সেফটি বাস্তবায়ন করা।  
     নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা চালু করা।  
    ৪. আইনি ও রাজনৈতিক সংস্কার 
    শ্রমিক ইউনিয়নের অধিকার দেওয়া।  
    শ্রমিকদের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করা । 


    বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প বিশ্বব্যাপী সাফল্য অর্জন করলেও পোশাক শ্রমিকরা আজও মানবেতর জীবনযাপন করছেন। নিরাপদ কর্মপরিবেশ, ন্যায্য মজুরি, নারী ও শিশু অধিকার নিশ্চিত করা ছাড়া এই শিল্পের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। এই সংকট সমাধানে সরকার, মালিকপক্ষ, আন্তর্জাতিক ক্রেতা এবং সুশীল সমাজের সম্মিলিত একান্ত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
    আশার কথা, গত বছর বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলশ্রুতিতে গঠিত নতুন সরকার শ্রমিকদের বেতন কাঠামো, নিরাপত্তা এবং ন্যায্য অধিকার নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে [১৩]। এসকল উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের সকল শ্রমিক সুদিনের দেখা পেলেই প্রকৃতপক্ষে মে দিবস সার্থকতা লাভ করবে। এর-ই ধারাবাহিকতায় পোশাক শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকার ও প্রাপ্য সম্মান পেলে এদেশে পোশাক খাতে স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে। এভাবে পোশাক খাতের সফলতার গল্পটা আরও দীর্ঘায়িত হবে এবং এদেশের উন্নতি ও অগ্রগতিতে গার্মেন্টস সেক্টর বা পোশাক খাতের অবদান চির অমলিন হয়ে থাকবে এটাই সকলের প্রত্যাশা। 

    লেখক
    মো: রিজওয়ানুল ইসলাম 
    সাধারণ সদস্য, কনটেন্ট রাইটিং টিম, 
    টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারস সোসাইটি।
    ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড রিসার্চ (নিটার)


    সার্বিক সহযোগিতায় ও অনুপ্রেরণায়,
    লাবিবা সালওয়া ইসলাম
    টিম লিডার, কনটেন্ট রাইটিং টিম,
    টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারস সোসাইটি।
    ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড রিসার্চ (নিটার)।

    RELATED ARTICLES

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Related News

    - Advertisment -

    Most Viewed