বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ, যা ২০২৩ সালে প্রায় ৪৭ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করেছে। [১] দেশের মোট রপ্তানি আয়ে ৮০% এবং জিডিপিতে প্রায় ১১% অবদান তৈরি পোশাকশিল্পের। প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিতের পাশাপাশি পরোক্ষভাবে প্রায় ১.৫ কোটি মানুষ এই খাতে নিয়োজিত।[২] কিন্তু এখনও আমাদের দেশে উৎপাদিত পোশাকের নিজস্ব ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে দেশীয় তৈরি পোশাকের স্বীকৃতি অর্জন যথেষ্ট কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়নি।
দেশীয় ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠার ব্যর্থতার কারণ
পোশাক শিল্পে আমাদের যাত্রার সূচনালগ্ন থেকেই লক্ষ্য ছিল সাশ্রয়ী মূল্যে দ্রুত পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানি করে ব্যক্তিগত পর্যায়ে মুনাফা অর্জন। ফলশ্রুতিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও দূরদৃষ্টির অভাবে এ শিল্পের সামগ্রিক মান ও ব্র্যান্ডিংয়ে কখনোই যথেষ্ট মনোযোগ দেওয়া হয় নি।
আন্তর্জাতিক বাজারে নিজস্ব ব্র্যান্ড দাঁড় করানোর লক্ষ্যে পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্যের মানের দিকে দৃষ্টিপাত করে নি, বরং সাশ্রয়ী শ্রম বাজারের নির্ভর করে স্বল্পমূল্যে পোশাক উৎপাদন করেছে। যা দেশীয় ব্র্যান্ড সৃষ্টিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। এছাড়াও, সামাজিক দায়িত্ব ও শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে পোশাক উৎপাদনকারী অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। অনেক গার্মেন্টস কারখানা শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক বাজারে ব্র্যান্ড সৃষ্টি বাধাগ্রস্ত করছে।[৩][৪] উপরন্তু, আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের চাপের কারণে এবং অর্ডার প্রাপ্তি ও মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়ই দরপত্রে কম মূল্য উল্লেখ করে, যার ফলে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি প্রদান সম্ভব হয় না। [৫] [৬] [৭]
আন্তর্জাতিক বাজারে দেশীয় পণ্যের স্বীকৃতির অভাব
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে ব্র্যান্ডিং এবং আন্তর্জাতিক দৃশ্যমানতার বা গ্রাহকের দৃষ্টি আকর্ষণের অভাব লক্ষণীয়। এমনকি, “Made in Bangladesh” লেবেলটি নিজস্ব ব্র্যান্ড হিসেবে নয় বরং কেবল OEM বা থার্ড-পার্টি উৎপাদক হিসেবে থাকে।[৮]
সরকার এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান যথাযথভাবে ব্র্যান্ড ডেভেলপমেন্টে (ট্রেডমার্ক সাপোর্ট, ডিজিটাল মার্কেটিং, আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী) সহায়তা করছে না। আন্তর্জাতিক সাসটেইনেবিলিটি এবং নিরাপত্তা প্রচেষ্টা থাকলেও, তা এখনও বৈশ্বিক বাজারে স্বীকৃতি ও বৈশ্বিক পর্যায়ে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য যথেষ্ট নয়।
কিছু শিল্প সুরক্ষা ও পরিবেশ-বান্ধব উদ্যোগ চালু থাকলেও, আন্তর্জাতিক বাজারে তা খুব বেশি স্বীকৃত নয়। যদিও ধীরে ধীরে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের ব্যাপারে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রচেষ্টা করা হচ্ছে।[৩] [৯]
উত্তরণমূলক পথ
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পকে টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ পর্যায়ে উন্নীত করতে হলে একসাথে কয়েকটি দিককে গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রথমত, দেশীয় ব্র্যান্ড নির্মাণ ও শক্তিশালীকরণ অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে সরকার ও শিল্প সংগঠনসমূহ ডিজিটাল মার্কেটিং, আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী, ট্রেডমার্ক সুরক্ষা এবং ব্র্যান্ড বিকাশে বড় ধরনের বিনিয়োগ করতে পারে। একই সঙ্গে সাসটেইনেবল উৎপাদন, LEED সার্টিফিকেশন, নিরাপদ কারখানা ও CSR কার্যক্রমকে বৈশ্বিক পরিসরে তুলে ধরতে হবে।
দ্বিতীয়ত, শ্রমিক অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে হবে। Accord বা Worker Driven Social Responsibility (WSR) মডেলের মতো উদ্যোগের মাধ্যমে ন্যায্য মজুরি, সম্মানজনক পরিশোধ ও শ্রমিক নিরাপত্তা বাস্তবায়ন অপরিহার্য।
তৃতীয়ত, শিল্পকে স্থিতিশীল ও বৈচিত্র্যময় করতে হবে। শুধু সস্তা শ্রমবাজারের উপর নির্ভর না করে মান, নিরাপত্তা ও সাসটেইনেবিলিটির সমন্বয়ে বৈশ্বিক বাজারে একটি সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করতে হবে। এর সঙ্গে উদ্ভাবনী প্রযুক্তি ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমাধান, যেমন মোবাইল-ভিত্তিক সরবরাহ-শৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা, উৎপাদন সময় ও মানোন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
চতুর্থত, সরকারের সক্রিয় নীতিমালা ও বহুমাত্রিক সমর্থন জরুরি—ট্রেড সুবিধা, রপ্তানি প্রণোদনা, উচ্চমান নিয়ন্ত্রণ এবং শ্রম সুরক্ষা আইন কঠোর বাস্তবায়নের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি উন্নত করতে হবে।
বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প তার বৃহৎ রপ্তানি পরিসর এবং অর্থনৈতিক অবদানের কারণে ইতিবাচক পরিচিতি অর্জন করেছে। তবে দেশীয় ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা ও আন্তর্জাতিক বাজারে স্বীকৃতি এখনও সীমিত। সামাজিক দায়িত্বের (CSR) অভাব, শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি অপ্রতুলতা, অধিক মুনাফা অর্জনের অপচেষ্টা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব এই ব্যর্থতার মূল কারণ। আমাদের গৌরবের পোশাক শিল্পকে বৈশ্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য করতে প্রয়োজন সাসটেইনেবিলিটি ভিত্তিক ব্র্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, আন্তর্জাতিক শ্রমনিষ্ঠা চুক্তির অংশীদারিত্ব, এবং সরকার ও শিল্প মালিকদের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট সকলের সমন্বিত পদক্ষেপ। এভাবেই বাংলাদেশি পোশাক শিল্প শুধু উৎপাদন নয়, বরং আস্থার প্রতীক ও মর্যাদাপূর্ণ ব্র্যান্ড হিসেবে বিশ্বমঞ্চে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে।
Reference:
[১]
https://www.economicsobservatory.com/whats-happening-in-bangladeshs-garment-industry#:~:text=In%201983%2D84%2C%20apparel%20accounted,China%20(see%20Figure%201)%20.
[২]
https://cpd.org.bd/fdi-needed-for-rmgs-sustainability/#:~:text=Foreign%20direct%20investment%20(FDI)%20is,(CPD)%2C%20said%20yesterday
[৩]
https://www.voguebusiness.com/sustainability/bangladesh-wants-to-change-the-narrative-around-its-manufacturing-practices
[৪]
https://www.researchgate.net/publication/365021220_CSR_Failures_in_Bangladeshi_Apparel_Industry_An_Agency_Theory_Perspective
[৫]
Business & Human Rights – Low-cost orders
https://www.business-humanrights.org/en/latest-news/bangladesh-garment-industry-facing-crisis-as-global-brands-reduce-orders-demand-low-costs-during-energy-crisis-wpftc/
[৬]
Al Jazeera – Brands pay below cost
https://www.aljazeera.com/news/2023/1/11/fashion-brands-paid-less-than-production-cost-to-bangladesh-firm
[৭]
University of Aberdeen – high street fashion brands reportedly paying below
https://www.abdn.ac.uk/news/16616/
[৮]
Economics Observatory – What’s happening in Bangladesh’s garment
https://www.economicsobservatory.com/whats-happening-in-bangladeshs-garment-industry
[৯]
The Financial Express – Greening garment industry in Bangladesh
https://thefinancialexpress.com.bd/views/views/greening-garment-industry-in-bangladesh
লেখক
মো: রিজওয়ানুল ইসলাম
সাধারণ সদস্য, কনটেন্ট রাইটিং টিম,
টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারস সোসাইটি।
ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড রিসার্চ (নিটার)
সার্বিক সহযোগিতায় ও অনুপ্রেরণায়,
লাবিবা সালওয়া ইসলাম
টিম লিডার, কনটেন্ট রাইটিং টিম,
টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারস সোসাইটি।
ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড রিসার্চ (নিটার)।

