Friday, May 9, 2025
Magazine
HomeBTMA, BGMEA & BKMEAসুতোয় গাঁথা নারীশক্তি

সুতোয় গাঁথা নারীশক্তি

. ভূমিকা  :
টেক্সটাইল শিল্প বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির অন্যতম প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ খাত। এটি শুধুমাত্র পোশাক তৈরির সাথে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। যুগের পর যুগ ধরে নারীশ্রম এই শিল্পের অন্যতম চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। আধুনিক টেক্সটাইল শিল্পে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ কেবল উৎপাদন বৃদ্ধিই করেনি, বরং সমাজে তাদের মর্যাদা ও স্বাধীনতাও বৃদ্ধি করেছে।


২. ইতিহাস  ও নারীদের অবদান  :
বিশ্বের টেক্সটাইল শিল্পে নারীদের উপস্থিতি বিশাল। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পোশাক কারখানায় নারী শ্রমিকদের ভূমিকা অপরিসীম বাংলাদেশের তৈরি পোশাক (RMG) শিল্পে প্রায় ৪০ লক্ষ শ্রমিক কাজ করেন, যার মধ্যে প্রায় ৮০% নারী।নারীরা সেলাই, কাটিং, কোয়ালিটি কন্ট্রোল, ফিনিশিং, প্যাকিং ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে কাজ করে থাকেন।
নারীদের এই যাত্রাটি শুরু হয়েছিল যাদের হাত ধরে, জানাব রিয়াজ উদ্দিন এর মেয়ে ফাতিমা বেগম ১৯৭৭ সালে রিয়াজ গার্মেন্টস লিমিটেড যোগ দেন তার পর আর একটা নাম নাজমা চৌধুরী। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের প্রথম নারী কোয়ালিটি কন্ট্রোলার, ডিজাইনার ও লাইন চিফ ছিলেন নাজমা চৌধুরী। ১৯৭৯ সালে দেশ গার্মেন্টস আধুনিক মেশিনে প্রশিক্ষণ নিতে দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে অবস্থিত বিশ্বখ্যাত দাইয়ু কোম্পানির পোশাক কারখানায় যেই ১৩৩ জন শ্রমিক ও মিড লেভেল ম্যানেজারকে পাঠিয়েছিল, তাদেরই একজন ছিলেন এই নাজমা চৌধুরী। 


ওই সময়ে ঢাকার আর্ট কলেজ (চারুকলা ইনস্টিটিউট) থেকে সদ্য স্নাতক সম্পন্ন করা নাজমা চৌধুরী ৬ মাসের প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফেরেন। অন্য আরো ১৪ নারী ছিলেন তার দলে, যাদের মধ্যে তিনি ছাড়া বাকী নারীরা ছিলেন শ্রমিক। এই উদ্যোক্তাদের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী। বাংলাদেশের অন্যতম পুরনো রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা বৈশাখী। ১৯৭৯-৮০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন একজন নারী। বর্তমানে তৈরি পোশাক কারখানায় অনেক নারী ঊর্ধ্বতন নির্বাহী পদে অধিষ্ঠিত এবং নতুন প্রজন্মের নারীরা সফলতার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন।


গার্মেন্টস খাতে কাজ করা নারী শ্রমিকদের গড় বয়স মাত্র ১৮ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে, অর্থাৎ তরুণ নারীরা সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছেন। ভারতের হস্তশিল্প এবং হস্তচালিত তাঁত শিল্পে প্রায় ৭০% শ্রমিক নারী। তাঁরা কুটির শিল্পের মাধ্যমে স্থানীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন।এছাড়াও, নারীরা এখন ফ্যাশন ডিজাইনার, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার, মান নিয়ন্ত্রক (Quality Inspector) এবং ব্যবস্থাপনা পর্যায়েও নিজের জায়গা তৈরি করছেন।


৩. রপ্তানি আয়ে নারীদের অবদান :
টেক্সটাইল এবং গার্মেন্টস শিল্প অনেক দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত। নারীদের শ্রম এ আয়ে বড় ভূমিকা রাখছে। তৈরি পোশাক শিল্প দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮১% প্রদান করে।২০২৩ সালে বাংলাদেশের গার্মেন্টস রপ্তানি আয় ছিল প্রায় ৫৫০০ কোটি মার্কিন ডলার, যার পেছনে মূল ভূমিকা ছিল নারী শ্রমিকদের।
আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড যেমন H&M, Zara, Walmart, Primark— এদের সরবরাহ চেইনে বাংলাদেশের নারী শ্রমিকরা প্রধান ভূমিকা পালন করে।ভিয়েতনামে ৩৫ লক্ষের বেশি শ্রমিক গার্মেন্টস খাতে কাজ করেন, যার অর্ধেকের বেশি নারী। রপ্তানি আয়ের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসে টেক্সটাইল ও পোশাক খাত থেকে।নারীদের শ্রমের কারণে এসব দেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে পেরেছে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার দ্রুত বেড়েছে।

৪. নারীর আত্মনির্ভরশীলতা, সামাজিক অবস্থানের উন্নয়ন ও শিক্ষার বিস্তারে প্রভাব  :
নারীদের কর্মসংস্থান কেবল ব্যক্তি পর্যায়ে নয়, বৃহত্তর সামাজিক পরিবর্তনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। একজন কর্মরত নারী নিজের ও পরিবারের খরচ বহনে সক্ষম হন।নিজের আয়ে সংসারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা বৃদ্ধি পায়। ব্যক্তিগত সঞ্চয় এবং ছোট ব্যবসা শুরু করার মতো সক্ষমতা তৈরি হয়।গার্মেন্টস খাতে কর্মরত অনেক নারী আগে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিলেন। কাজের মাধ্যমে তারা নিজেকে শিক্ষিত করতে সক্ষম হয়েছেন। বর্তমানে অনেক নারী শ্রমিক তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উন্নয়নে সহায়ক।নারীর স্বাধীন চলাচল এবং পারিবারিক সম্মানও বৃদ্ধি পেয়েছে।বাংলাদেশের মিরপুর, টঙ্গী ও আশুলিয়া এলাকায় অনেক নারী গার্মেন্টস শ্রমিক এখন নিজেদের সঞ্চয় দিয়ে দোকান, মুদি ব্যবসা, ছোট কারখানা খুলেছেন।SEWA (Self Employed Women’s Association) ভারতে নারীদের টেক্সটাইল ভিত্তিক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলছে, ফলে নারীদের জীবনমান উন্নত হয়েছে। বিভিন্ন গার্মেন্টস কোম্পানি কর্মরত নারী শ্রমিকদের জন্য প্রশিক্ষণ ও প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচি চালু করেছে। অনেক নারী রাতের স্কুলে গিয়ে বা অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করছেন।


৫।  টেক্সটাইল শিল্পে নেতৃত্ব ও উদ্যোক্তা চিন্তাধারা :
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে নারীদের কর্মসংস্থান উল্লেখযোগ্য হলেও, নেতৃত্ব পর্যায়ে তাদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত সীমিত। বিজিএমইএ-এর তথ্য অনুযায়ী, মাত্র ৫–৭ শতাংশ নারী ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে এবং ৯ শতাংশ সুপারভাইজার পদে কর্মরত, যেখানে ৮৪ শতাংশ নারী রয়েছেন নিম্নবেতনভুক্ত পদে। বিশ্ববাজারে টেকসই পোশাকের চাহিদা ২০২৩ সালে ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বাংলাদেশ বর্তমানে ১৯২টি LEED-সার্টিফায়েড কারখানা নিয়ে পরিবেশবান্ধব উৎপাদনে বিশ্বে অগ্রগামী। নারী শ্রমিকদের টেকসই উৎপাদন প্রক্রিয়া বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি, বিশ্বব্যাংকের এক জরিপে উঠে এসেছে যে, নারীরা ধীরে ধীরে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছেন, এবং সহজ ঋণ ও প্রশিক্ষণের সুযোগ বৃদ্ধি পেলে আগামী দশ বছরে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা ২০–৩০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।


৬। কর্মক্ষেত্রের প্রতিবন্ধকতা  :
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত নানা রকম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন। এর মধ্যে প্রথমে  পারিশ্রমিকের ক্ষেত্রে পুরুষদের বেশি প্রাধান্য দেয়া হয় নারী শ্রমিকের চেয়ে। শ্রম আইনে ৮ ঘণ্টা কাজের কথা বলা হলেও, প্রায় ৭০ শতাংশ নারী শ্রমিক প্রতিদিন ১০–১২ ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য হন। বিজিএমইএ-এর ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, ৪০ শতাংশ কারখানায় এখনো স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত হয়নি, এবং ৩৫ শতাংশ নারী শ্রমিক যৌন হয়রানি ও মানসিক চাপের শিকার হন। এছাড়া, মাত্র ২৫ শতাংশ নারী শ্রমিক মাতৃত্বকালীন ছুটির সুবিধা পান। এসব চ্যালেঞ্জ দূর করতে কার্যকর নীতিমালা, সচেতনতা বৃদ্ধি ও নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি।নারী শ্রমিকদের দীর্ঘ সময় ধরে খারাপভাবে বায়ুচলাচলহীন কারখানায় কাজ করতে হয়, যার ফলে রক্তাল্পতা ও প্রজননজনিত দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি হয়। 
RMG খাতে নারীদের জন্য শিশু পরিচর্যা এখনো একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। যদিও ২০০৬ সালের বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী, যেসব কারখানায় ৪০ জন বা তার বেশি নারী শ্রমিক কাজ করেন, সেখানে ডে-কেয়ার সুবিধা থাকা বাধ্যতামূলক—তবুও বাস্তবে এর বাস্তবায়ন অত্যন্ত কম। ২০২১ সালের দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মাত্র ২৩% কারখানা এই আইনি শর্ত পূরণ করে।


৭। ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা :
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রেক্ষাপটে তৈরি পোশাক শিল্পে অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা ২০৩০ সালের মধ্যে ২৫% হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে (আইএলও)। ফলে নারীদের টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণ ও ডিজিটাল দক্ষতা বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি, কর্মপরিবেশের মানোন্নয়ন, মাতৃত্বকালীন সুবিধা নিশ্চিতকরণ এবং যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কার্যকর নীতিমালা গ্রহণ ভবিষ্যৎ উন্নয়নের পথে সহায়ক হবে। সহজ ঋণ ও উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা আগামী এক দশকে ২০–৩০% বাড়ানো সম্ভব।


৮। উপসংহার  :
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে নারীদের ভূমিকা অপরিসীম হলেও, তারা এখনো বৈষম্য, নিরাপত্তাহীনতা ও স্বীকৃতির ঘাটতির মধ্যে কাজ করছেন। কর্মপরিবেশ উন্নয়ন, নেতৃত্বে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং দক্ষতা বিকাশের মাধ্যমে এই শিল্পে নারীদের অবস্থান আরও সুসংহত করা সম্ভব। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে, নারী শ্রমিকদের সুরক্ষা, অধিকার ও সম্ভাবনার বাস্তবায়নে রাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট মহলের কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।


লেখক
মোছা: রাফিয়াতুন জান্নাত
অ্যাপারেল ইঞ্জিনিয়ারিং 
রংপুর টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, রংপুর

অভিষিক্তা সরকার পুজা 
ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং 
রংপুর টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, রংপুর
আসমাউল হুসনা 
ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং
রংপুর টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, রংপুর
অর্পণা রায় 
ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং 
রংপুর টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, রংপুর


রেফারেন্স:
www.wikipedia.com
www.textilefocus.com
www.lightcastlepartners.com
www.womenentrepreneursreview.com

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related News

- Advertisment -

Most Viewed