Friday, March 29, 2024
More
    HomeCampus Newsচতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ উত্তরণ,দক্ষ প্রকৌশলী তৈরি করছে নিটার, প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার

    চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ উত্তরণ,দক্ষ প্রকৌশলী তৈরি করছে নিটার, প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার

    লেখা: মোঃ আবুবকর সিদ্দিক, এস এম আশিক ও মোহাম্মদ আবুল হাসান শিবলী

    সচরাচর বাংলাদেশের উচ্চাভিলাষী বিভিন্ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে দেখা যায় বিশাল বিনিয়োগের তুলনায় সার্থকতা খুব সামান্যই থাকে। অনেক প্রকল্পের অবস্থা এরকম যে, “কাজীর গরু কাগজে আছে গোয়ালে নেই”। কিন্তু নিটারের ক্ষেত্রে সেই গল্পটি সম্পূর্ণ বিপরীত। কাগজে না থাকলেও বাস্তবে বাংলাদেশের বস্ত্র খাতে বৈপ্লবিক অবদান রেখে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) শিক্ষা ও গবেষণা কেন্দ্র ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড রিসার্চ (নিটার)’।

    ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে ঢাকা রপ্তানী প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (ডিইপিজেড) সংলগ্ন ১৪ একর জায়গা নিয়ে সাভারের নয়ারহাটে অবস্থিত নয়াভিরাম নিটার ক্যাম্পাস। ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠার শুরুতে এটি ছিল বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস কর্পোরেশন (বিটিএমসি)-এর অধীনে থাকা টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির কর্মকর্তাদের কারিগরি প্রশিক্ষণের জন্য একটি ট্রেনিং সেন্টার এবং তখন এর নাম ছিল টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি ডেভোলেপমেন্ট সেন্টার (টিআইডিসি)। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তন করে বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ টেক্সটাইল ট্রেনিং রিসার্চ এন্ড ডিজাইন (নিট্রেড)’ নামে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, যার বাস্তবায়ন ২০০৭ সালে সমাপ্ত হয়।

    ইনস্টিটিউট পরিচালনার লক্ষ্যে এরপর প্রতিষ্ঠানটি পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) এর মাধ্যমে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ‘বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস কর্পোরেশন (বিটিএমসি)’ এবং ‘বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)’ এর মধ্যে ২০০৮ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী পরিচালিত হয়ে আসছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় কর্ত্বক ২০১৩ সাল হতে প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড রিসার্চ (নিটার)’ করা হয়।

    বর্তমানে নিটারে স্নাতক পর্যায়ে ৫টি বিভাগে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইন্ডাস্ট্রিয়াল এন্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং (আইপিই), ফ্যাশন ডিজাইন এন্ড অ্যাপারেল ইঞ্জিনিয়ারিং (এফডিএই), কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) ও ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ২টি কোর্স এম এস সি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ও এমবিএ ইন টেক্সটাইল এন্ড অ্যাপারেল ভ্যালু চেইন চালু রয়েছে। বর্তমান বিভাগসমূহে প্রায় ২০০০ শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত আছে।

    ইনস্টিটিউটের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বাংলাদেশসহ এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে উচ্চতর ডিগ্রীধারী অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলী ও দক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ নিয়োজিত রয়েছেন। নিটার ক্যাম্পাসে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য পৃথক হোস্টেল ও শিক্ষকগণের জন্য রয়েছে আবাসিক কোয়ার্টার। ইতোমধ্যে ৭টি ব্যাচের গ্র্যাজুয়েটগণ ডিগ্রী সম্পন্ন করে দেশের স্বনামধন্য টেক্সটাইল ও সহায়ক শিল্পপ্রতিষ্ঠানে দক্ষতা ও সুনামের সাথে কাজ করে যাচ্ছে। নিটারের শিক্ষার্থীদের অনেকেই দেশের বাহিরে ইউরোপ আমেরিকা সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করছে।

    টেক্সটাইল ও সহায়ক শিল্পের  জ্ঞানার্জনের জন্য নিটারে রয়েছে কার্যক্ষম অত্যাধুনিক মেশিনারি, সুসজ্জিত ল্যাবরেটরি এবং মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর সমৃদ্ধ আধুনিক ক্লাসরুম। এই ইনস্টিটিউটে রয়েছে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ইয়ার্ন ম্যানুফ্যাকচারিং ল্যাব, ফেব্রিক ম্যানুফ্যাকচারিং ল্যাব, ওয়েট প্রসেসিং ল্যাব, অ্যাপারেল ম্যানুফ্যাকচারিং ল্যাব, টেস্টিং ও কম্পিউটার এইডেড ডিজাইন (ক্যাড) ল্যাব। এই প্রতিষ্ঠানে রয়েছে যুগোপযোগী মেশিনারি সমৃদ্ধ ইন্ডাস্ট্রিয়াল এন্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং ল্যাব। টেক্সটাইল ও সহায়ক শিল্পের প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে নিত্যনতুন চাহিদা পূরণের জন্য ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে সামনে রেখে নিটারে গড়ে তোলা হয়েছে ফ্যাশন ডিজাইন এন্ড অ্যাপারেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের আধুনিক ল্যাবসমূহ। সহায়ক শিল্পের চ্যালেঞ্জসমূহকে সামনে রেখে সর্বাধুনিক সিএসই ও ইইই বিভাগের প্রয়োজনীয় সকল ল্যাব সাজানো হয়েছে দক্ষ ও বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের আদলে। এছাড়াও নিটারে রয়েছে বেসিক ও এলায়েড সায়েন্সের আধুনিক ল্যাবরেটরি, ডিজিটালাইজড লাইব্রেরী, ক্যাফেটেরিয়া, খেলার মাঠ, সম্পূর্ণ ওয়াই-ফাই জোন ক্যাম্পাসসহ প্রয়োজনীয় সকল অবকাঠামোগত সুবিধা।

    সরাসরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে না থাকলেও নিটারের পরিচালনা কাঠামো অনেকটা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের অনুরূপ। বিটিএমএ, বিটিএমসি, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত ১৫ জনের একটি পরিচালনা পর্ষদের অধীনে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হয়, যার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকেন বিটিএমএ এর প্রেসিডেন্ট। সরকারি বা বেসরকারি কোন খাত থেকে নিটারের জন্য নির্ধারিত কোন প্রণোদনা না থাকলেও এদেশের অনেক টেক্সটাইল শিল্প-প্রতিষ্ঠানের মালিকগণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিটারের শিক্ষা ও কারিগরি খাতে উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন সময় লক্ষাধিক টাকা অনুদান দিয়ে আসছেন।

    নিজস্ব আয় দ্বারা পরিচালিত নিটার একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং অলাভজনক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি প্রজেক্টের সাথে নিটারের কারিগরি সহযোগিতা বিদ্যমান থাকলেও সরকারি বা বেসরকারি খাত থেকে কোন আর্থিক প্রণোদনা নেই। তবে নিটারের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান জনাব মোহাম্মদ আলী খোকন (চেয়ারম্যান, ম্যাকসন্স গ্রুপ) নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকগণের নিকট থেকে মেধাবি এবং দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাবৃত্তি এবং উন্নত ল্যাব প্রতিষ্ঠার জন্য অনুদান এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মেশিনারিজ সংগ্রহের ব্যবস্থা করেছেন। সেই সাথে তিনি নিজেও বিভিন্ন সময় নিটারে আর্থিক অনুদান এবং কারিগরি সহায়তা প্রদান করে আসছেন।

    এছাড়াও গবেষণাক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততা বাড়াতে নিটারে রয়েছে সেন্টার ফর রিসার্চ এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশন (CRIR)। ২০১৫ সালে টেক্সটাইল ট্যালেন্ট হান্ট প্রতিযোগিতায় আনারসের পাতা থেকে ফাইবার উদ্ভাবন করে প্রথম স্থান অর্জন শিক্ষার্থী কাজী হাসানুল হক। ২০১৮ ও ২০১৯ সালের নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জের ঢাকা রিজিওনাল বিভাগে চ্যাম্পিয়ন Ges ২০১৯ সালে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি, দিল্লি)-তে অনুষ্ঠিত ফাংশনাল টেক্সটাইল এন্ড ক্লোদিং কনফারেন্স (এফটিসি) প্রতিযোগিতায় বিশ্বের নব্বইটি দেশের মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করে নিটার। 

    বর্তমানে দেশের মোট জিডিপির প্রায় ১৮ শতাংশ অর্জিত হয় টেক্সটাইল খাত হতে। দেশীয় জিডিপির এই লক্ষ্যমাত্রাকে সামনের দিকে আরও এগিয়ে নিতে এবং দেশের অর্থনীতিকে শিল্পবান্ধব করে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার টেক্সটাইল শিল্প হতে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অধিক রপ্তানী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন। রপ্তানী আয়ের এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ক্রেতাদের চাহিদাভিত্তিক ও রপ্তানী নির্ভর পণ্য উৎপাদন, বিশ্বব্যাপী বৈচিত্রময় পোশাক বিপণন এবং সম্ভাব্য ক্রেতাদের সাথে শিল্পবান্ধব সম্পর্ক স্থাপন অত্যন্ত জরুরী। বর্তমানে বাংলাদেশে টেক্সটাইল খাতে সুদক্ষ জনশক্তি দেশের প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল হওয়ায় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, চীন ও শ্রীলঙ্কাসহ অন্যান্য দেশ থেকে আগত প্রায় ৬ লক্ষ বিদেশী জনশক্তি দেশের শ্রমবাজার দখল করে আছে।

    একবিংশ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লবের এই প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান ধরে রেখে এই শিল্পে নেতৃত্ব প্রদানে টেক্সটাইল ও সহায়ক শিল্পের আধুনিকায়ন এবং উন্নয়নের জন্য গবেষণা ও প্রযুক্তিনির্ভর উচ্চ শিক্ষা প্রদানে দেশে বর্তমানে একটি মাত্র বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যা এককভাবে বর্তমান চাহিদার প্রেক্ষিতে দক্ষ প্রকৌশলীর চাহিদা মেটাতে সক্ষম নয়।

    এমতাবস্থায়, এই অল্প সময়ে অধিক সফলতা এবং নিরবে নিভৃতে দেশের বস্ত্র খাতে অসামান্য অবদান রাখা সত্ত্বেও নিটারে কোন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা নেই। দেশের প্রথম পিপিপি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও এখনো বাংলাদেশ সরকারের পিপিপি কর্তৃপক্ষের প্রকল্পসমূহের তালিকায় নিটারের নাম অন্তর্ভুক্তই হয়নি।

    মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শীতা ও বিচক্ষণ নেতৃত্বে বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা পায় এবং প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ দেশের অবস্থানে উন্নীতকরণের লক্ষ্যে, বর্তমান সরকার ১০০টি নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যার মধ্যে টেক্সটাইল ও সহায়ক শিল্প প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে। দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প এলাকা ‘ঢাকা রপ্তানী প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (ডিইপিজেড)’ সংলগ্ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিটারকে একটি সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়নের রূপরেখায় গুরুত্বপূর্ন অবদান রাখবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রযুক্তিনির্ভর পড়াশোনায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে যে ৬০ শতাংশ টেকনিক্যাল গ্রাজুয়েট ইশতেহার প্রদান করেছেন, সেই লক্ষ্য অর্জনের পথকে মসৃণ করতে নিটারের সকল অবকাঠামোগত সুবিধা থাকায় নিটার একটি সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জোরালো দাবি রাখে।

    *লেখকগণ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড রিসার্চ (নিটার) এর টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক

    RELATED ARTICLES

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    - Advertisment -

    Most Popular

    Recent Comments