পোশাক শিল্প শুরু থেকেই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এটি দেশের শতভাগ রপ্তানি আয়ের ৮০ ভাগ যোগান দিয়ে থাকে এবং জিপিডির প্রায় ১০ ভাগ অবদান রাখে। দেশের প্রায় ৪৫ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে পোশাক শিল্পের মাধ্যমে।
এই পোশাক শিল্পের পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে —প্রাকৃতিক গ্যাস। গ্যাসের উপর নির্ভর করে টেক্সটাইলের বিভিন্ন প্রক্রিয়া যেমন – ডাইং, স্পিনিং, ফিনিশিং সহ প্রায় সব উৎপাদন প্রক্রিয়া। ক্যাপটিভ পাওয়ার জেনারেশনে—মূল জ্বালানি হিসেবে গ্যাস ব্যবহৃত হয়।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে গ্যাস সংকট পোশাক শিল্পের জন্য বড় হুমকি স্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পোশাক শিল্পে গ্যাসের ব্যবহার
১. বাষ্প উৎপাদন (Steam Generation):
ডাইং, ব্লিচিং, ফিনিশিং ও হিট সেটিং প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় বয়লারের মধ্যে উচ্চ তাপমাত্রার বাষ্প ব্যবহার করে, যা প্রধানত গ্যাসচালিত বয়লার দ্বারা উৎপাদন হয়।
২. স্পিনিং ও বয়ন মেশিন চালনা:
অনেক কারখানা স্পিনিং ও বয়নের জন্য ক্যাপটিভ পাওয়ার সিস্টেম ব্যবহার করা হয়, যেখানে গ্যাসচালিত জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে মেশিন চালানো হয়।
৩. সিন্জিং (Singeing):
সিন্জিং প্রক্রিয়া হলো কাপড়ের উপর থেকে ছোট ছোট তন্তু গুলো সরিয়ে ফেলা। যেখানে কাপড়ের অতিরিক্ত তন্তু গ্যাসের শিখা সরাসরি কাপড়ে লাগিয়ে ফিনিশিং করা হয়।
৪. ক্যাপটিভ পাওয়ার জেনারেশন:
টেক্সটাইল কারখানায় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎতের প্রয়োজন হয়। কিন্তু সরকার নির্ধারিত বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতির জন্য বহু কারখানা গ্যাস-চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল।
বর্তমান সময়ে গ্যাস সংকটের প্রভাব
বাংলাদেশে ২০২৪ সালের শেষ দিক থেকে টেক্সটাইল শিল্পে গ্যাস সরবরাহ মারাত্মকভাবে কমে গেছে। সরকার ও বিতরণ সংস্থাগুলোর তথ্য মতে গ্যাসের চাপ স্বাভাবিক অবস্থায় যেখানে ১০-১২ PSI হওয়া উচিত, সেখানে অনেক শিল্প এলাকায় এর পরিমাণ নেমে এসেছে ১.৫-২ PSI– এ।
গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের আশ্বাসে গত কয়েক বছরে দফায় দফায় ৩০০ শতাংশ এর অধিক মূল্য বৃদ্ধি করা হয়, একই সঙ্গে মিল মালিকদের সিকিউরিটি বাবদ অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করতে হয়। শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাসের সরবরাহের নামে মূল্যবৃদ্ধি করা হলেও বাস্তবে গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।
বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “সরকার গ্যাসের দাম বাড়ালেও সরবরাহ বাড়েনি। দ্রুত এলএনজি আমদানি বাড়িয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না করলে বিপর্যয় অনিবার্য।”
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) জানিয়েছে, প্রতিটি ইউনিট প্রতিদিন গড়ে ২৫ লাখ টাকার লোকসান গুণছে। অ্যাসোসিয়েশনের আওতাভুক্ত প্রায় ৫০০ স্পিনিং মিলের মধ্যে অনেকেই উৎপাদন বন্ধের মুখে।
সময়মতো পোশাক উৎপাদন না হওয়ায় বিদেশি ক্রেতারা অন্যান্য দেশ থেকে পোশাক আমদানির সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এতে করে দেশীয় ব্র্যান্ডের ইমেজ নষ্ট হচ্ছে। স্থানীয় ভাবে সুতা উৎপাদন কমে যাওয়ায় অন্য দেশের থেকে সুতা আমদানি করতে হচ্ছে, ফলে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ পড়ছে।
গ্যাস সংকটের কারণ সমূহ
গ্যাস রিজার্ভ কমে যাওয়া
নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারে বিলম্ব
এলএনজি (LNG) আমদানি ব্যয়বহুল হওয়ায় আমদানি কমে যাওয়া
শিল্প ও আবাসিক খাতে অনিয়মিত বণ্টন
পুরনো ও অনুন্নত গ্যাস বিতরণ অবকাঠামো
গ্যাস সংকটের সম্ভাব্য সমাধান
১. জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি
Waste Heat Recovery System ও Energy Efficient Boiler ব্যবহারে গ্যাস সাশ্রয় সম্ভব।
২. বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার
এলপিজি (LPG), বায়োমাস বা বৈদ্যুতিক বয়লার চালু করা যেতে পারে।
৩. নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার
সোলার পাওয়ার, বায়োগ্যাস, উইন্ড টারবাইন ইত্যাদি ব্যবহারের মাধ্যমে গ্যাসের উপর নির্ভরতা কমানো সম্ভব।
৪. সরকারি সহায়তা ও নীতিমালা পরিবর্তন
বিশেষ করে শিল্পে গ্যাস বরাদ্দ বৃদ্ধির জন্য স্বতন্ত্র নীতিমালা গ্রহণ করা দরকার।
৫. গ্যাস আমদানি চুক্তি
LNG আমদানি চুক্তি দ্রুত সম্পন্ন করে শিল্পে সরবরাহ বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প গ্যাসের উপর গভীরভাবে নির্ভরশীল। বর্তমান গ্যাস সংকট শিল্পের উৎপাদন, রপ্তানি ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাই, জ্বালানি ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বৃদ্ধি, বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরের মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলা করা জরুরি। এতে করে শিল্পের স্থায়িত্ব ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
Writer
Khadija Khatun
Deputy Sub-Leader of Content Writing Team
Textile Engineers Society