Tuesday, April 16, 2024
More
    HomeTechnical Textileকফি থেকে ফাইবার।

    কফি থেকে ফাইবার।


    ▪নবম শতকের ঘটনা।  ইথিওপিয়া মালভূমিতে ছাগল চড়াতো খালদি নামের এক রাখাল। একদিন সে বিস্ময় সহকারে লক্ষ্য করে তার পালের ছাগলগুলো এক গাছের লাল রঙের ফল খেয়ে আগের চেয়ে বেশি প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠেছে। সারাদিন বেশ জোশের সাথে ঘুরে বেড়ায়, লাফালাফি করে, রাতেও না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়। কৌতূহলী খালদি লাল রঙের সেই ফল মুখে দিয়ে স্বাদ গ্রহণ করে এবং মোহাবিষ্ট হয়ে ঘোষণা দেয়, “এই ফলগুলো স্বর্গ থেকে পাঠানো হয়েছে।” পরবর্তী সময়ে সে কিছু ফল কাছে অবস্থিত এক আশ্রমে নিয়ে যায়।


    আশ্রমের প্রধানকে এই ফলের মুগ্ধকর কীর্তির কথা বলতেই তিনি এগুলোকে শয়তানের কারসাজি বলে বেশ বিরক্তির সাথে আগুনে নিক্ষেপ করেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই রোস্ট হওয়া তাজা কফি দানার গন্ধে পুরো আশ্রম ভরে যায়। বয়সে তরুণ এক অবাধ্য ভিক্ষু আশ্রম প্রধানের কথা অমান্য করে কিছু দানা ঠাণ্ডা করে গরম পানিতে ছেড়ে দেয় এবং প্রথমবারের মতো কফি খাওয়ার আদর্শ উপায় উদঘাটন করে। সে বেশ বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করে এই দানা দ্বারা তৈরি পানীয় তাদের পুরো রাত জেগে প্রার্থনা করার শক্তি প্রদান করে।


    এই ছিল কফি আবিষ্কারকে ঘিরে সবচাইতে বেশি প্রচলিত কিংবদন্তী। যদিও লোকমুখে অন্য গল্পও শোনা যায়। তবে নবম শতকের পরে আস্তে আস্তে পুরো পৃথিবীতে কফির জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। সে সময় ‘কফিয়া অ্যারাবিকা’ নামেই একে ডাকা হতো। দশম শতকের প্রথম দিকে পদার্থবিদ এবং দার্শনিক ইবনে সিনা বুখারি কফির ঔষধি বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রথম নথিপত্র রচনা করেন। এগারোশ’ সালের দিকে আরব ব্যবসায়ীরা ইয়েমেনে এনে কফির বীজ বপন করে। সে সময় আরবে কফি পরিচিত ছিল ‘কাহওয়া’ বা ঘুমে বাধাদানকারী হিসেবে।


    কোরআনে নিষিদ্ধ মদ বা অন্যান্য নেশাজাতীয় পানীয়র বদলে অধিকাংশ মানুষই কফিকে বেছে নিলো। ১৪৫৪ সাল থেকে পুরো পনেরো শতক পর্যন্ত আরবের মুসলিমদের মাঝে কফির জনপ্রিয়তা বাড়তেই থাকে। সেসময়ই ইয়েমেনের বন্দর নগরী এডেনের (Aden) এক মুফতির কল্যাণে প্রথম কফিশপ তৈরি হয়, যার নাম ছিল ‘কাভেহ কানেস (Kaveh Kanes)’। এরপর পাড়া, মহল্লায়, রাস্তার ধারে তৈরি হতে থাকে বিভিন্ন কফিশপ। মুসাফির, মেহমান, বৃদ্ধ, জোয়ানদের অবসর কাটানো, গল্প, রাজনৈতিক আলাপ করা, গানে মশগুল হওয়ার জায়গায় স্থান পায় এই কফিশপগুলো। যদিও ১৫১১ সালের দিকে প্রথমবারের মতো সেখানকার গভর্নর খালেদ বে-এর মাধ্যমে প্রথম কফির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।


    ▪ক্লান্তির সময়ে এক কাপ কফির জুড়ি মেলা ভার। অনেক সময় দেখা যায় বাসায় কফি কিনে অথবা উপহার পেয়ে ফেলে রাখা হয়েছে, মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এতগুলো কফি নষ্ট হয়ে গেল ভেবে আপনার খারাপ লাগছে, অথচ মেয়াদোত্তীর্ণ কফি পানীয় হিসেবে ব্যবহার পারছেন না। পানীয় ছাড়াও কফির যে ব্যবহারগুলো আছে সেগুলো জানলে আগামীবার আপনার কফিগুলো চমৎকার কাজে দেবে।
    সকালে এক কাপ কফি আমাদের মেজাজ ও সতর্কতার উন্নতি করে এবং আমাদের মানসিক উৎসাহ দেয়। বেশিরভাগ সময় গ্রাউন্ডেড কফি শিমগুলি আবর্জনায় ফেলে দেওয়া হয়, বা কখনও কখনও এটি সার হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ফ্যাব্রিক বাজারে একটি নতুন প্রক্রিয়া উদ্ভূত হয়েছে যার মধ্যে বর্জ্য গ্রাউন্ড কফি মটরশুটি পুনর্ব্যবহৃত কাপড় তৈরিতে একটি সৃজনশীল অ্যাপ্লিকেশন প্রত্যক্ষ করেছে।
    জৈব পোশাক সম্পর্কে ধারণা এখন একটি সমুদ্র-পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে চলছে, ফ্যাশন ডিজাইনার এবং র‌্যাম্প শোয়ের সাথে ট্রেন্ড আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশ বান্ধব পোশাকের ধারণাটি বাড়িয়ে তুলছে। পর্যাপ্ত মিডিয়া মনোযোগের ব্যারাসহ, ইকো ফ্যাশন এখন মূলধারার ভোক্তা সচেতনতায় প্রবেশ করেছে। 


    ▪কফি গ্রাউন্ড ফাইবার ,CUD, আনারস পাতা বা পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের বোতল থেকে তৈরি কাপড় বর্তমানে অতি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাশন শিল্পের সবুজ ভবিষ্যতের ভিত্তি। টেক্সটাইল শিল্পকে কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করা বেশিরভাগ সংস্থান মূলত সুতি, পাট, লিনেন ইত্যাদি প্রাকৃতিক উৎস থেকে পেয়েছে। ফলস্বরূপ কফি সুতাটি বহু-কার্যকরী এবং প্রতিদিন ব্যবহৃত গৃহস্থালী আইটেম থেকে বহিরঙ্গন এবং ক্রীড়া পারফরম্যান্স পরিধান থেকে শুরু করে বিভিন্ন পণ্যগুলিতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
    সুতা তৈরিতে ব্যবহৃত কফি ভিত্তিগুলি স্টারবাকসের মতো বিশ্বের বৃহত্তম কফি বিক্রেতাদের কাছ থেকে নেওয়া এবং পুনর্ব্যবহার করা হয়। এইভাবে, সংস্থাটি কফি গ্রাউন্ডগুলিতে দ্বিতীয় জীবন দেয় যা অন্যথায় আবর্জনায় শেষ হতো। সিনটেক্স শিল্প একটি বিশ্বখ্যাত তাইওয়ানীয় সংস্থা যা ক্রিয়ামূলক ফ্যাব্রিক উৎপাদনের জন্য পরিচিত। সিনটেক্স সফলভাবে একটি নতুন পরিবেশ বান্ধব পণ্য তৈরি করেছে যা কফি গ্রাউন্ডের বর্জ্য থেকে তৈরি ফাইবার হিসেবে ব্যবহার করে। সিনটেক্স সাফল্যের সাথে 2008 সালে (এস ক্যাফে) পরিবেশ বান্ধব কফি সুতা আবিষ্কার করেছিল, যা প্লাস্টিকের বোতল এবং কফির ভিত্তি থেকে তৈরি হয়েছিল। এটি সবুজ, উচ্চ-প্রযুক্তি,পরিবেশ বান্ধব,ডিওডোরাইজিং, দ্রুত-শুকনো, UV প্রতিরোধী এবং এর রয়েছে অনেকগুলি পৃথক পৃথক বৈশিষ্ট্য।


    ▪কফি ফাইবারের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যঃ
    দ্রুত শুকানোঃ
    এস ক্যাফে প্রযুক্তির প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো কফি গ্রাউন্ড ফাইবারের দ্রুত শুকানোর ক্ষমতা রয়েছে যার অর্থ এটি ক্রমাগত আর্দ্রতা ত্বক থেকে ফ্যাব্রিকের বাইরের পৃষ্ঠের দিকে সরিয়ে দেয়।
    গন্ধ নিয়ন্ত্রণঃ
    ন্যানো-আকারের কফি গ্রাউন্ডগুলি স্থায়ীভাবে ফাইবারে এম্বেড করা থাকে। এই কফি কণাগুলি গন্ধ শোষণ করে। কফি ফাইবার থেকে তৈরি আরও ফ্যাব্রিক আমাদের শরীর থেকে দুর্গন্ধ শুষে নিতে সহায়তা করে যা সারাদিন ধরে উৎপাদিত হয়।


    UV সুরক্ষাঃ
    ক্যাফে কফি গ্রাউন্ডে বিশাল মাইক্রোস্কোপিক ছিদ্র সরবরাহ করা হয় যা ফাইবার বা সুতা বা ফ্যাব্রিকের জন্য দীর্ঘস্থায়ী প্রাকৃতিক এবং রাসায়নিক-মুক্ত ঝাল তৈরি করে, যা UV রশ্মিকে প্রতিবিম্বিত করে এবং আরামদায়ক বহিরঙ্গন অভিজ্ঞতা সরবরাহ করে।
    ইকো-বন্ধুত্বপূর্ণঃ
    ক্যাফে প্রযুক্তি পুনর্ব্যবহৃত কফি ভিত্তিগুলি ব্যবহার করে যা অন্যথায় স্থলপথে চলে যেত। 


    ▪কফি গ্রাউন্ড ফাইবারের ব্যবহারঃ
    ১. স্মোক ড্রেস।

    ২. কার্পেট।

    ৩. খেলোয়াড়দের পোশাক।

    ৪.  দুর্গন্ধ দূর করার পোশাক।

    ৫. চাদর।

    ৬. টি-শার্ট।

    ৭. শীতের পোশাক।

    ▪কফির অন্যান্য বৈশিষ্ট্যঃ
    মাথার ত্বক ও চুলেঃ
    বাজার থেকে কেনা রাসায়নিক শ্যাম্পু পরিবর্তনের জন্য কখনো কফির দানা স্ক্রাবার হিসেবে মাথায় ব্যবহার করা যায়। এতে করে মৃত কোষ দূর হবে, চুলে ভ্যাপসা গন্ধ থাকলে সেটাও চলে যাবে। গবেষণায় দেখা যায়, কফিতে থাকা ক্যাফেইন আমাদের শরীরের রক্ত চলাচল বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। শুধু পানীয় হিসেবেই নয়, বরং এর বাহ্যিক ব্যবহারও বেশ কাজের। চুল রাঙাতে যে পণ্যের ব্যবহার করা হয়, তাতে শত শত রাসায়নিক উপাদান থাকে। এদের কোনো কোনোটি ক্যান্সার পর্যন্ত বয়ে আনতে পারে। কফি যদিও কৃত্রিম রঙের মতো কার্যকর নয়, তবু চুলের রঙকে সে আরো গাঢ় করে তুলতে পারে। মেয়াদোত্তীর্ণ কফি হতে পারে এতদিন চলে আসা বিষাক্ত রঙের প্রাকৃতিক বিকল্প।


    রান্নার কাজেঃ
    মাংস ম্যারিনেট বা নরম করার ক্ষমতা আছে কফির, কারণ এটা কিছুটা অম্লীয়। দানাদার কফি, যেটা কফি বানানোর পর থেকে যায়, সেটাকে ঠান্ডা করে মাংস রান্নার দু’ঘন্টা আগে মাংসের গায়ে ঘষলে মাংস নরম হয়ে যায়, রান্নায় ব্যতিক্রমী স্বাদও আসে। মিল্কশেক বা স্মুদির কথা বাদই দিলাম, চকোলেট কেকের গোলায় একটু কফি যোগ করলে সেটাও বেশ সুন্দর, সুস্বাদু গন্ধ আনে।
    পোষা-প্রাণীর গায়ের পোকা তাড়াতেঃ
    বাড়িতে পোষা প্রাণী থাকলে প্রায়ই দেখা যায় তাদের গায়ে ছোট কালো পোকা। এই পোকা তাড়ানোর অনেক ওষুধ বাজারে পাওয়া গেলেও সেগুলো যেমন বিষাক্ত, তেমনি তাদের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ক্ষতিকর। পোষা প্রাণীর পোকা ছাড়ানো একইসাথে ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সৌভাগ্যবশত, এই পোকাগুলো কফির ঘ্রাণ পছন্দ করে না। প্রাণীর গায়ের পশম শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে তাতে কফির দানা ঘষে পরে ভালো মতো ধুয়ে শুকিয়ে ফেলতে হবে। কফি রাসায়নিক ওষুধের মতো কার্যকরী কখনোই হবে না। কিন্তু এটা ব্যবহার করে পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায় প্রাকৃতিকভাবে। বিড়াল, কুকুর কফি খেয়ে ফেললে সেটা তাদের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই পোষা প্রাণীর জন্য কফি ব্যবহারে পশু চিকিৎসকের মতামত নেওয়া এবং সতর্ক থাকা উচিৎ।
    কফির ভিন্নধর্মী ব্যবহারগুলো যে শুধু আপনাকে অপচয়ের হাত থেকে বাঁচাবে তা-ই নয়, বরং সুবাসিত উপকারে ঋণী করে রাখবে আপনাকে!


    Sajjadul Islam Rakib

    Campus Ambassador – TES -NITER (10th Batch)     

    RELATED ARTICLES

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    - Advertisment -

    Most Popular

    Recent Comments