Friday, April 19, 2024
More
    HomeKnitwearনীরবে বিকশিত নিটিং শিল্প

    নীরবে বিকশিত নিটিং শিল্প

    দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য নিট পোশাকের আয়তন এখন অনেক বড়। নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা, গাজীপুর ও চট্টগ্রামেই সিংহভাগ নিট পোশাক কারখানা অবস্থিত। এর মধ্যে কিছু আছে বৃহদায়তন কম্পোজিট কারখানা, যেখানে নিট পোশাকের জন্য ফেব্রিক বা থানকাপড় তৈরি থেকে শুরু করে ডাইং-প্রিন্টিং সবই করা হয় চূড়ান্ত উৎপাদনের আগে। কিন্তু মাঝারি ও ছোট আকারের নিট পোশাক কারখানাগুলো এসব কাজ বাইরে থেকে করায়। আর তাই ডাইং, প্রিন্টিং ও নিটিংয়ের জন্য গড়ে উঠেছে আলাদা আলাদা শিল্প খাত। বিশেষত নিটিং হিসেবে পরিচিত সুতা থেকে থানকাপড় বা ফেব্রিক তৈরির কাজটি এখন করছে দেশের এক হাজারের বেশি কারখানা। চাহিদা বাড়ায় দুই দশক ধরে অনেকটা অপরিকল্পিতভাবে বিকশিত হয়ে এই নিটিং শিল্পে এখন বিনিয়োগের পরিমাণ অন্তত দুই হাজার কোটি টাকা। প্রধানত নারায়ণগঞ্জেই গড়ে উঠেছে এই শিল্প। আর কিছু আছে গাজীপুরে।

    নিটিং শিল্পের পেছনের কথা চিত্তাকর্ষকই বলা যায়। পাকিস্তান আমলে ষাটের দশকে নারায়ণগঞ্জ শহরের নয়ামাটিতে হোসিয়ারি শিল্প গড়ে ওঠে। দেশের মানুষের গেঞ্জি ও অন্তর্বাসের চাহিদা মেটাতে থাকে হোসিয়ারি শিল্প। সে সময় সুতা থেকে থানকাপড় বুননের যন্ত্রকে বডি মেশিন বলা হতো। আর তখন এসব বডি মেশিনের উৎপাদনক্ষমতা ছিল খুবই সীমিত।

    আশির দশকে নয়ামাটির হোসিয়ারি কারখানা মিনার টেক্সটাইলের স্বত্বাধিকারী জার্জিস হোসেন এ রকম বডি মেশিনে উৎপাদিত ফেব্রিক দিয়ে কিছু টি-শার্ট তৈরি করে প্রথমবারের মতো বিদেশে নিটওয়্যার পণ্য রপ্তানি শুরু করেন। সেই সময় টি-শার্ট যান্ত্রিকভাবে আয়রন বা ইস্ত্রি করার ব্যবস্থা না থাকায় জার্জিস হোসেনকে কাজটি করতে হয়েছিল সরাসরি হাতে। আজকে মিনার টেক্সটাইল বাংলাদেশের এক সুবৃহৎ বস্ত্র ও নিট কারখানা।

    জার্জিস হোসেনের দেখানো পথে পরবর্তী সময়ে কনক হোসিয়ারি, নেভি হোসিয়ারিসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নিটপণ্য রপ্তানি শুরু করে ইউরোপের বাজারে। আস্তে আস্তে নারায়ণগঞ্জে গড়ে উঠতে থাকে রপ্তানিমুখী নিট পোশাক উৎপাদনের কারখানা। কিন্তু পুরোনো বডি মেশিনগুলোর উৎপাদনক্ষমতা কম হওয়ায় এই শিল্পের মালিকেরা প্রথমে কোরিয়া থেকে নতুন প্রযুক্তির বডি মেশিন আমদানি শুরু করেন, যা রপ্তানিমুখী নিট শিল্পে ব্যবহূত হওয়ার কারণে নিটিং মেশিন নামে পরিচিতি পায়। একপর্যায়ে বাংলাদেশের নিট পণ্য ইউরোপের বাজার দখল শুরু করে। শিল্পমালিকেরাও জাপান, তাইওয়ান, জার্মানি থেকে আধুনিক যন্ত্র আমদানি করতে থাকেন।

    চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বড় কারখানার জোগানদার হিসেবে ছোট ছোট কারখানা গড়ে উঠতে থাকে, যারা মূলত ছোট যন্ত্রে ফেব্রিক তৈরি করতে থাকে। হোসিয়ারির থানকাপড় থেকে হাল আমলের নিট ফেব্রিক তৈরির কাজটি এখন অত্যাধুনিক যন্ত্রে সম্পন্ন হচ্ছে। কম পুঁঁজিতে ছোট উদ্যোক্তা হিসেবে নিটিং শিল্পমালিকেরাও কিছু মানুষের কর্মসংস্থান গড়ে তুলেছেন। সাধারণত একটি নিটিং কারখানায় পাঁচ থেকে ১০ জন শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করেন।

    নিটিং শিল্পমালিকেরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় ২০০৫ সালে গড়ে তোলেন বাংলাদেশ নিটিং ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। ২০১২ সালে এ সমিতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে অনুমোদন পায়। সমিতির তথ্য অনুযায়ী এক হাজারের বেশি নিটিং কারখানায় এখন যন্ত্র বা মেশিন রয়েছে ১০ হাজার। প্রতিদিন গড়ে ২০ লাখ কেজি সুতা থেকে ফেব্রিক বা থানকাপড় উৎপাদন হয়। মোট শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০ হাজার। অবশ্য এই হিসাবটি রপ্তানিমুখী কম্পোজিট নিটওয়্যার কারখানাগুলোর নিটিং মেশিনের হিসাবের বাইরে।

    বাংলাদেশ নিটিং ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবু তাহের শামীম প্রথম আলোকে বলেন, মূলত নিটওয়্যার শিল্পের ফেব্রিকের চাহিদা মেটানোর জন্যই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা নিটিং শিল্প গড়ে তুলেছেন। তবে বর্তমানে এই শিল্প বড় সংকটে রয়েছে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেশি। এক বছরের বিদ্যুতের মূল্য বেড়েছে ছয়বার। আসন্ন গ্রীষ্ম মৌসুমে লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
    শামীম আরও অভিযোগ করে বলেন, সরকারের নির্দেশে এই শিল্পের শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো হলেও উৎপাদন মজুরি বা মূল্য বাড়েনি। তিনি আরও জানান, গত দুই বছরে কারখানার ভাড়া, ভাড়া বাবদ অগ্রিমের পরিমাণ বাড়ানো, নিটিং মেশিন ও খুচরা যন্ত্রাংশের মূল্য বেড়ে গেছে। প্রতি কেজি সুতা থেকে ফেব্রিক বুনন করতে উৎপাদন খরচ হয় সিঙ্গেল জার্সি ১৫ টাকার বেশি। অথচ নিটিং ব্যবসায়ীদের দেওয়া হচ্ছে ১০ টাকা।

    এভাবে লোকসান দিয়ে চলা সম্ভব নয় বলে ১৫ মার্চ থেকে প্রতি কেজি সুতা থেকে ফেব্রিক বুনন উৎপাদন খরচ ১৫ টাকা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তবে বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নেতাদের অনুরোধে তা দুই টাকা কমিয়ে ১৩ টাকা ধার্য করা হয়েছে। তবে ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে নিটিং উৎপাদন মজুরি প্রতি কেজি ১৫ টাকা কার্যকর হবে। নিট পোশাক শিল্পই এই নিটিংয়ের প্রধান ভোক্তা।

    জানা গেছে, নিটিং শিল্পে ৪০ কাঠচন্দের সুতা নিটিং করে ফেব্রিক বানানো হয়। সিঙ্গেল জার্সি, স্লাব, ভিসকস সিঙ্গেল জার্সি, পিকে/লেকোস্ট, হেভি জার্সি, লোকড়া, ফ্লিস, টেরি ফ্লিস, রিব, ইন্টালক, প্লেন কলার, টিপিং কলার, রেইজিং কলার, কাফ ইত্যাদি ডিজাইনের নামে সুতো থেকে ফেব্রিকস বুনন করা হয় নিটিং মেশিনে।

    দেশের নিটিং শিল্পমালিকদের আরেকটি অভিযোগ হলো, অনেক পোশাক কারখানার মালিক তাঁদের বকেয়া সময়মতো পরিশোধ করেন না। ফলে তাঁদের ক্ষুদ্র বিনিয়োগ ঝুঁকির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাঁরা এই ছোট অথচ প্রয়োজনীয় শিল্পটির জন্য সরকারের সহযোগিতাও চেয়েছেন।

    সুত্র -প্রথম আলো

    RELATED ARTICLES

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    - Advertisment -

    Most Popular

    Recent Comments