Monday, December 2, 2024
Magazine
More
    HomeLife Style & Fashionপৃথিবীর সবচেয়ে দামি কাপড়ের সন্ধানে।

    পৃথিবীর সবচেয়ে দামি কাপড়ের সন্ধানে।

    মানব সভ্যতার ইতিহাস থেকে আজ আমরা সবাই জানি কীভাবে একসময়ের বনমানুষ কালের বিবর্তনে আজকের সভ্য জগতে পা রেখেছে। এই বিবর্তনের পরিক্রম হাজার বছরের, লক্ষ বছরের। আমরা জেনেছি কীভাবে প্রকৃতির কাছে অসহায় আদিম মানুষ একসময় পাথরের সাথে পাথর ঘষে আগুন তৈরি করতে শিখল। সময়ের প্রভাবে তারাই সেই পাথরের তৈরি নানা অস্ত্র তৈরি করে নিজেদের রক্ষা করেছে, বন্য পশু-পাখি শিকার করেছে। আবার তারাই একসময় বন্য প্রাণীদের পোষ মানিয়ে এক নতুন সমাজের সৃষ্টি করেছে।

    বর্তমানে সবাই নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভালো পোশাকের সন্ধানে থাকে। সচেতন মানুষেরা শুধুমাত্র পোশাকের বাহ্যিক সৌন্দর্য নিয়েই মেতে থাকে না। পোশাক কোন কাপড় দিয়ে তৈরি, আরামদায়ক নাকি, এর স্থায়িত্ব কেমন বা কাপড়টি পরিবেশবান্ধন নাকি তা নিয়েও ক্রেতাদের থাকে হাজার প্রশ্ন। পোশাক নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো নিত্যনতুন নকশা ও আকর্ষণ নিয়ে হাজির হচ্ছে আমাদের মাঝে। কিন্তু আপনি জানেন কি বিশ্বের সবচেয়ে দামী, উষ্ণ ও মোলায়েম পোশাকের নাম কী? অথবা কী দিয়ে তৈরি হয়ে থাকে সেই পোশাক?

    নিশ্চয়ই কোনো নামী দামী ব্র্যান্ড কিংবা বিখ্যাত কোনো কাপড় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কথা ভাবছেন! ব্যাপারটি কিন্তু ঠিক সেরকম নয়। বিশ্বের সবচেয়ে দামী, উষ্ণ ও আরামদায়ক কাপড় উৎপাদিত হয় এক প্রজাতির প্রাণীর পশম থেকে। প্রাণীটির নাম ভিকুনা। অবাক হচ্ছেন? তাহলে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশের একটি প্রাণীর সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। প্রাণীটির নাম ‘কাশ্মীরি ছাগল’, যার পশম থেকে উৎপাদিত হয় জগদ্বিখ্যাত ‘কাশ্মীরি শাল’। কিন্তু ভিকুনার পশম থেকে উৎপাদিত পোশাক কাশ্মীরি শালের থেকেও বহুগুণে দামী ও আরামদায়ক।

    ▪ভিকুনার উৎপত্তিস্থলঃ

    এই দুর্লভ প্রাণীটির সন্ধান মেলে দক্ষিণ আমেরিকার স্বল্প কয়েকটি দেশে। বিশেষত চিলির অ্যান্ডিস আলটিপ্লানো পর্বতে তাদের বিচরণ করতে দেখা যায়। ক্যামেলিড পরিবারের প্রাণীদের মধ্যে ভিকুনা সবচেয়ে ছোট ও মায়াবী গঠনের হয়ে থাকে। এদের দেহের উপরিভাগ কমলা এবং নিচের অংশ সাদা রঙের পশম দ্বারা আবৃত থাকে। এই উষ্ণ পশমই মূলত তাদের পর্বতের ঠাণ্ডা আবহাওয়া থেকে রক্ষা করে। চিলির পাশাপাশি আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া ও পেরুতেও ভিকুরের সন্ধান মেলে। সাধারণত সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ১০,০০০-১৫,০০০ ফুট উঁচু পর্বতভূমিতে তারা বসবাস করে। 

    শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে ভিকুনার পশম থেকে তৈরিকৃত কাপড় শুধুমাত্র উষ্ণ কিংবা মোলায়েম নয়, এটি বিশ্বের সবচেয়ে দামী কাপড়ও বটে! কিন্তু কতটা দামী? আসলে দাম শুনলে আপনার চোখ আকাশে উঠবে!

    ❝ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের ভাষ্যমতে, ভিকুনার পশম দিয়ে তৈরি একেকটি কোটের মূল্য ২১,০০০ ডলারেরও অধিক। যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় পৌনে দুই কোটি টাকার সমান। ভিকুনার পশম দিয়ে তৈরি একেকটি মাফলারের দাম গড়ে ৪,০০০ ডলার; অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা।❞

    ভিকুনার পশম দিয়ে তৈরিকৃত পোশাকের ফিনিশিং এতটাই মসৃণ হয় যে, এর চেয়ে অভিজাত পোশাক আর কোনো উল দ্বারা তৈরি করা সম্ভব হয় না।

    ▪ভিকুনা ফাইবার কি?

    পৃথিবীতে লাক্সারি যত সুতা তৈরি করা হয় তার মধ্যে সেরা হলো ভিকুনা উল। এটি সাধারণত কমলা – বাদামী রঙের হয়ে থাকে। ভিকুনা প্রাণীটির একটি পশম মানুষের চুলের থেকে ৮ গুন চিকন। ভিকুনা ফাইবার খুবই নরম মসৃন এবং অন্যান্য প্রাণীর পশমের চাইতে আভিজাত্যময়। ফাইবারটি বেশ মজবুত ও পানি ধরে না এবং স্থিতিস্থাপক। ভিকুনা উল দিয়ে প্রস্তুতকৃত পোষাক ওজনে অত্যন্ত হালকা পাতলা হলে ও শরীরের তাপমাএাকে প্রচন্ড গরম করতে সক্ষম।

    ▪গাঠনিক বৈশিষ্ট্যঃ

    -ফাইবারের মাইক্রোনেয়ার ১২-১৪ মাইক্রোমিটার।
    -ডায়ামিটার ৬-১২ মাইক্রোমিটার।
    -ফাইবারের দৈর্ঘ্য ৩৫ মি.মি.

    ▪ভিকুনা থেকে উৎপাদিত পোশাকঃ

    -সোয়েটার
    -শাল
    -মাফলার
    -স্যুট-কোট
    -হ্যাট
    -নীটওয়্যার

    ▪ভিকুনা ফেব্রিকের বৈশিষ্ট্যঃ

    -এটি অনেক উষ্ণ এবং মোলায়েম ফেব্রিক।
    -এটি প্রাকৃতিকভাবে অনেকটা নরম প্রকৃতির।
    -অন্যান্য ফেব্রিকের মতো খসখসে স্বভাবের নয়।
    -এটি বায়োডিগ্রেডেবল বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন।
    -Water Proof Breathable fabric.
    -তাপমাত্রা সংবেদনশীল।
    -এটি অত্যন্ত নিখুঁত ও স্বচ্ছ।

    ▪ভিকুনার অজানা ইতিহাসঃ

    পোশাকের সাথে আবহাওয়া এবং সংস্কৃতির সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। ভিন্ন ভিন্ন আবহাওয়ার মানুষ বিভিন্ন সময়ে তাদের আবহাওয়ার সাথে সামঞ্জস্য রেখে পোশাক নির্বাচন করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের মতো উষ্ণ অঞ্চলের মানুষ যতটা সম্ভব লম্বা পোশাক বেছে নিয়েছে রোদ থেকে শরীরকে বাঁচাতে। শীতপ্রধান অঞ্চলের মানুষ আঁটসাঁট পোশাক বেছে নিয়েছে প্রধান পোশাক হিসেবে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায়, পোশাক নির্বাচনে যুক্ত হয়েছে রাজনীতি, অর্থনীতি ও সৌন্দর্যবোধ। ঐতিহাসিকভাবেই ভিকুনার কাপড় অভিজাত পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ইনকা সভ্যতার মানুষেরা বিশ্বাস করতো ভিকুনা হত্যা মহাপাপ; তাদের মধ্যে ঐশ্বরিক ক্ষমতা রয়েছে। শুধুমাত্র রাজপরিবারের সদস্যরা জীবিত থাকাকালে এই মূল্যবান প্রাণীর পশম দ্বারা তৈরিকৃত পোশাক পরিধানের অনুমতি পেতেন। তবে সাধারণ মানুষ মারা গেলে, তাদের মৃতদেহের সাথে এক টুকরা ভিকুনা কাপড় দিয়ে দেয়া হতো। আর এই কাপড়কে অভিহিত করা হতো ‘ঈশ্বরের কাপড়’ হিসেবে। 

    এই কাপড় এতটা দামী হওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ হচ্ছে এর দুর্লভতা। একটি ভিকুনার দেহে বছরে মাত্র ১ পাউন্ড পরিমাণ পশম তৈরি হয় এবং প্রতি তিন বছরে মাত্র একবার তাদের দেহ থেকে পশম সংগ্রহ করা যায়। আরেক সমস্যা হলো, তাদেরকে আবদ্ধ জায়গায় লালন পালন করা কিংবা ফার্মিং করা যায় না। ফলে প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা ভিকুনাদের দেহ থেকে প্রতি তিন বছর পর পর যতটুকু পশম সংগ্রহ করা যায় তাকে মহাদুর্লভই বলা চলে।

    ইনকা সভ্যতার সময় ভিকুনা হত্যা মহাপাপ হওয়াতে সেসময় এই প্রাণীরা দ্রুত বংশ বিস্তার করতে থাকে। দক্ষিণ আমেরিকান অঞ্চলে প্রচুর সংখ্যক ভিকুনা বেড়ে উঠতে থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৫৩২ সালে স্প্যানিশ বিজেতারা যখন ইনকা সাম্রাজ্য দখল করে নেয়, তখন থেকে তারা প্রচুর পরিমাণে ভিকুনা হত্যা করতে থাকে। ভিকুনার গোশত ভক্ষণ ও চামড়া সংগ্রহে রাখা তাদের বিলাসিতায় পরিণত হয়। এছাড়া ভিকুনার পশম দ্বারা তৈরি সুতাকে বাণিজ্যিকভাবে তারা ‘নয়া বিশ্বের সিল্ক’ হিসেবে পরিচিত করে তোলে। এর ফলে মাত্র ১০০ বছরের ব্যবধানে এটি একটি দুর্লভ প্রাণীতে পরিণত হয়। ইনকা সাম্রাজ্যে যেখানে ১ মিলিয়নের অধিক ভিকুনা ছিল, ১৯৬০ সালে এসে তা সংখ্যায় মাত্র ৫ হাজারে এসে দাঁড়ায়। ফলে সবাই নড়েচড়ে বসেন এবং এই প্রাণীটি রক্ষায় তৎপর হয়ে ওঠেন। তখন থেকে এই প্রাণীটি হত্যা, ক্রয়-বিক্রয় এবং এর পশম ও উলের ব্যবহার নেতিবাচক কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। 

    ১৯৭৬ সালে ভিকুনা বিপন্ন প্রাণীর তালিকাভুক্ত হয় এবং জাতিসংঘ এটি সংরক্ষণের জন্য বিস্তর প্রস্তাব গ্রহণ করে। এতে ভিকুনা ক্রয়-বিক্রয়ের উপর করা নজরদারি আরোপ করা হয় এবং ভিকুনার গোশত ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্রয়-বিক্রয় করা আইনত নিষিদ্ধ করা হয়। এই সিদ্ধান্ত বেশ কার্যকরী পদক্ষেপ হিসেবে উত্তম ফলাফল বয়ে নিয়ে আসে। দক্ষিণ আমেরিকার চারটি দেশে ফের দ্রুততার সাথে ভিকুনার সংখ্যা বাড়তে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগতি দেখা যায় পেরুতে। বর্তমানে দেশ চারটিতে প্রায় ১,৬০,০০০ ভিকুনা রয়েছে।

    ▪ভিকুনার বর্তমান অবস্থানঃ

    আরেকটি উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, এই আধুনিক যুগে এসেও ভিকুনার পশম সংগ্রহ ও উল তৈরিতে ইনকাদের শিখিয়ে যাওয়া আদি পদ্ধতির ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ভিকুনাদের ধরার জন্য একটি দীর্ঘ দড়ি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। দড়ির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত টুকরো টুকরো রঙ-বেরঙয়ের কাপড় ঝুলানো থাকে। এরপর সেই দড়ি দিয়ে ঘিরে তাদের একত্রিত করা হয়। এরপর একে একে উপযোগী ভিকুনার দেহ থেকে পশম কেটে তাদের আবার ছেড়ে দেয়া হয়। ভিকুনা ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধের পাশাপাশি দীর্ঘদিন যাবত এর পশম ও কাপড় বিক্রিও নিষিদ্ধ ছিল। পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালে শুধুমাত্র এর পশম ও কাপড় ক্রয়-বিক্রয়ের বৈধতা প্রদান করা হয়। এরপর থেকেই ভিকুনা উলের কাপড় বিশ্বের সবচেয়ে দামি, উষ্ণ, আরামদায়ক ও বিলাসবহুল কাপড় হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

    ২০০৮ সালে ভিকুনাকে বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী থেকে ‘অত্যন্ত উদ্বেগজনক’ প্রজাতির তালিকায় স্থান দেয়া হয়েছে।  ধীরে ধীরে এটি সাধারণ প্রাণীর তালিকায় নেমে আসবে এমনটাই আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

    ভিকুনা ও কাশ্মীরি ছাগলের পাশাপাশি আমাদের দেশের একটি অবহেলিত সম্পদের কথা না বললেই নয়; সেটি হচ্ছে ভেড়ার পশম। দুই যুগ আগেও আমাদের দেশে ভেড়ার পশম দ্বারা তৈরি জাজিম, বালিশ, পাপোশ ইত্যাদি অভিজাত পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এছাড়াও ভেড়ার পশম দিয়ে কম্বল, মাফলার, সোয়েটার, জায়নামাজ ইত্যাদি পণ্য উৎপাদন করা যায়। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে সেই শিল্প আমাদের মাঝ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এটা কি শুধুই অবহেলা? সেই প্রশ্ন রেখে আজকের মতো ইতি টানা হলো এখানেই।

    source: Roar.Media, magazinehorse.com

    Sajjadul Islam Rakib
    Campus Ambassador – TES
    National Institute of Textile Engineering and Research-NITER
    Batch-10

    RELATED ARTICLES

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Related News

    - Advertisment -

    Most Viewed