Tuesday, April 16, 2024
More
    HomeTechnical Textileইবাদতের জায়নামাজ এখন করোনা প্রতিরোধী

    ইবাদতের জায়নামাজ এখন করোনা প্রতিরোধী

    জুন ১৩২৫, ২১ বছরের এক যুবক বেরিয়ে পড়েন পৃথিবীর পথে। ত্রিশ বছর ঘোরেন দেশে দেশে। বাড়ি ছাড়ার সময় তাঁর কাছে ছিল যৎসামান্য অর্থ ও একটি জায়নামাজ। এই যুবক আর কেউ নন, বরং বিশ্ববিশ্রুত পর্যটক ইবনে বতুতা।আজ আমাদের গল্প তাকে নিয়ে নয়, বরং জায়নামাজ নিয়ে, যা হচ্ছে একটি টেক্সটাইল পন্য।অতি সম্প্রতি ইন্দোনেসিয়া করোনা প্রতিরোধক এক ধরনের জায়নামাজ আবিষ্কার করেছে। তাই আজ এই আর্টিকেলটি থেকে আমরা একটি সাধারন জায়নামাজ নিয়ে যেমন জানতে পারবো তেমনি জানতে পারবো করোনা প্রতিরোধক জায়নামাজের আদ্যপান্ত। 

    চলুন প্রথমেই জেনে নেয়া যাক জায়নামাজ কি?

    আমরা এখন জানবো জায়নামাজ বলতে আসলেই কি বোঝানো হয়। জায়নামাজ একটি ফারসি শব্দ ইংরেজিতে যাকে বলা হয় “Prayer mat” বা “The rug” ।জায়নামাজ বলতে সাধারণত নামাজের (মুসলিমদের প্রার্থনা) সময় মেঝেতে ব্যবহারের গালিচা কে বোঝায়। এর উপর দাঁড়িয়ে নামাজ পড়া হয়। তবে নামাজের সময় জায়নামাজ বিছানো বাধ্যতামূলক নয়। নামাজের স্থানের ধুলো থেকে রক্ষা এবং পবিত্রতা রক্ষার্থে জায়নামাজ ব্যবহৃত হয়। এটি বিভিন্ন সাইজ ও ডিজাইনের হয়ে থাকে। জায়নামাজ ইসলামী সংস্কৃতির অন্যতম নিদর্শন।

    জায়নামাজের ইতিহাস

    মহানবী (সাঃ) যে  জায়নামাজে নামাজ পড়তেন তাকে বলা হতো “খুমরাহ” যা খেজুর-গাছের-আঁশ থেকে তৈরি হতো। সেখান থেকেই মূলত জায়নামাজ এর যাত্রা শুরু। যদিও কার্পেট বুননের ইতিহাস মধ্য এশিয়াতে প্রায় ২০০০ বছরের পূরনো।ইরানে সেই চতুর্থদশ শতাব্দী থেকেই দারুন সব জায়নামাজ তৈরি হয়েছে। পারস্যের গালিচা শিল্পীরা বুনেছেন নানা ধরনের জায়নামাজ। পঞ্চদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে ইতালির রেনেসাঁ শিল্পী জিওভান্নি বেল্লিনি, ভিত্তোরে কারপাচ্চিও  এবং লোরেঞা লোত্তো তুরস্কের জায়নামাজকে তাদের ক্যানভাস করেন। এছাড়াও বিভিন্ন সময় রাজা-বাদশারা রাজ শিল্পী দিয়ে জায়নামাজের নকশা করেছেন।শ্রেষ্ঠ বয়ন শিল্পীরা সেসব বুনেছেন। তবে অটোমান সাম্রাজ্যের হাত ধরে এর প্রসার ঘটে।

    করোনা প্রতিরোধক জায়নামাজ

    মহামারী করোনা প্রতিরোধক জায়নামাজ তৈরি করেছে ইন্দোনেশিয়া। দেশটির পূর্ব জাভার ৫ পুচাং সুরাবায়া শহরের ওয়ারদাতুল উন্মাহ মোহম্মাদিয়া স্কুলের শিক্ষার্থীরা মুসলমানদের নামাজকে সহজ করতে “সাজানা” নামে একটি করোনা প্রতিরোধ জায়নামাজ তৈরি করেছে। জায়নামাজ গুলো ব্যবহার উপযোগী ও আকর্ষণীয় তৈরি করতে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ডিজাইন করেছে। জায়নামাজ গুলো প্রস্থে ৬০ সে.মি. ও লম্বায় 120 সে.মি.

    সাধারণ জায়নামাজ ও করোনা প্রতিরোধক জায়নামাজ তৈরীর প্রক্রিয়া

    বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জায়নামাজ তৈরি হলেও এর বুনন প্রক্রিয়ায় তেমন একটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছুটা পার্থক্য আছে। তবে আজ আমরা জায়নামাজ বুননের মূল প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করব। জায়নামাজ মূলত হ্যান্ড মেইড ও মেশিন ওয়েভ দুইভাবেই তৈরি হয় তবে হ্যান্ড মেড জায়নামাজ ব্যয় বহুল ও সময় সাপেক্ষ। জায়নামাজ মূলত উল থেকে তৈরি হলেও কটন, সিল্ক,ডাইস,ক্যামেল, হেয়ার, ব্যামবো সিল্ক,ব্যানানা সিল্ক,ভিসকস দিয়েও তৈরি হয়। উলের তৈরি জায়নামাজের গুণগত মান উলের গুনগত মানের উপর নির্ভরশীল। এজন্য প্রথমে পশমগুলো ছাঁটাই করার পর তা ভালো করে ধুয়ে কার্ডেট অর্থাৎ টিজিং প্রক্রিয়ায় সোজা করা হয়।

    এরপর সুতা গুলো কেটে আকর্ষণীয় রঙে রঞ্জিত করা হয় এবং ধীরে ধীরে রোদে শুকানো হয়। 
    এরপর সুতাগুলো  বুননের  ক্ষেত্রে দুই ধরনের নোট ব্যবহৃত হয়। ১/তুর্কি নোট ২/ পারসিয়ান নোটএই নোটিং পদ্ধতিগুলো  ব্যবহার করে একদিনে সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১৪ হাজার নোট বোনা হয়। 
    এরপর আরো কিছু প্রসেসিং করা হয় অর্থাৎ শেয়ারিং> কার্ডিং> স্পিনিং>লুম ফাউন্ডেশন >ওয়ার্প>ওয়েফট> সেড স্টকস>হ্যাডেল এই প্রক্রিয়াগুলোর  মাধ্যমে একটি পরিপূর্ণ জায়নামাজ তৈরি হয়। কিন্তু করোনা প্রতিরোধক জায়নামাজ তৈরীতে সুতার বদলে বিশেষ এক ধরনের প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়। তাই করোনা প্রতিরোধক জায়নামাজে সুতা বুননের প্রয়োজন হয় না।

    প্লাস্টিক প্রক্রিয়াকরন করে জায়নামাজ এ রূপদান করা হয়। এসকল জায়নামাজ গুলো অনেক নরম এবং এগুলো হাতে ডিজাইন করা। ওয়ারদাতুল উম্মাহ মোহাম্মাদিয়া স্কুলের হস্তশিল্পবিষয়ক এক শিক্ষক জানিয়েছেন, প্লাস্টিকের তৈরি নরম এ জায়নামাজগুলোর রং ম্লান হবে না। কারণ এতে নির্দিষ্ট গগুনগত মানসম্পন্ন রং ব্যবহার করা হয়েছে।এই জায়নামাজের মুল যে আর্কষন তা হচ্ছে জীবাণুনাশক স্প্রে ব্যবহার করে জায়নামাজগুলো জীবাণুনাশক করা যায় এবং তা এর গুনগত মানের কোনো ক্ষতি না করেই।

    জায়নামাজ ইন্ডাস্ট্রিঃ

    ২০০০ বছর পূর্বের মধ্য এশিয়ার কার্পেট বুনন শিল্প অটোমান, সাফাভি এবং মুঘলদের হাত ধরে এই ইন্ডাস্ট্রি জাতীয়  সম্পদে পরিণত হয়।তারা এই কার্পেট,জায়নামাজ ইউরোপ ও এর আশেপাশের অঞ্চলে বিক্রি শুরু করে। ১৬ শতাব্দীতে তুর্কি ও পারস্যে জায়নামাজ ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যাপক প্রসার হয়।এরপর আস্তে আস্তে এই ইন্ডাস্ট্রি ইউরোপসহ ইন্ডিয়া, চায়না  এসব অঞ্চলে বিস্তার লাভ করে। আমেরিকান ইন্ডিয়ানরা এর বুনন কৌশলের উন্নয়ন সাধন করে।বর্তমানে তুরস্ক,ইন্ডিয়া,পারস্য, স্পেন ফ্রান্স, ইংল্যান্ড সহ মধ্য এশিয়ার কিছু দেশ জায়নামাজ উৎপাদনের সক্রিয় রয়েছে। যদিও অঞ্চল ভেদে এদের ডিজাইন ও নামের তারতম্য দেখা যায়।তবে গুণগত মানের দিক দিয়ে টার্কিশ জায়নামাজের বেশ কদর রয়েছে। জায়নামাজ ইন্ডাস্ট্রির সাথে কার্পেট ইন্ডাস্ট্রিও জড়িত থাকায় এর বাজার অনেক বড়। মধ্য এশিয়ার আফগান, বালুচি, বোখরা নামক কিছু ঐতিহ্যবাহী কার্পেট রয়েছে। তাই বলা যায় এই জায়নামাজ ইন্ডাস্ট্রির রয়েছে ব্যাপক পরিসর।

    বিভিন্ন দেশে কার্পেট ও জায়নামাজ শিল্পের প্রধান প্রধান অঞ্চল গুলো নিচে দেওয়া হলোঃ

    চীন(China):কাশগর(Kashgar), আরকান্ত(Yarkant), খতান(Khotan), আক্সু(Aksu)
    ইন্ডিয়া(India):নিউ দিল্লি(New Delhi), জয়পুর(Jaipur), আগ্রা(Agra), ভাদোহি  অঞ্চল(Bhadohi Region)
    পাকিস্তান(Pakistan):কারাচি(Karachi), লাহোর(Lahore), পেশাওয়ার(Peshawar)
    ইরান(Iran):টাইব্রিয(Tabriz), আহার (Ahar), মিশকিন (Mishkin)
    তুর্কি(Turkey):হেরেকে(Hereke), বেরগামো(Bergama), কসাক (Kosak)
    তুর্কিস্তান(Turkestan):
    খিভা(Khiva), বুখারা(Bukhara), কেরকি(Kerki), সামারকান্দ(Samarkand)
    আফগানিস্তান(Afghanistan):হেরাত(Herat), মাইমানা(Maimana), আকশা(Aksha)

    এছাড়াও আরো বেশকিছু অঞ্চলে রয়েছে এই শিল্প।

    করোনা প্রতিরোধক জায়নামাজের বাজারঃ

    যদিও এই জায়নামাজ এখনো ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভাবে উৎপাদন শুরু হয়নি। তবে ওয়ারদাতুল উম্মা মোহাম্মদিয়া স্কুলের শিক্ষার্থীরা “সাজানা” নামক এই জায়নামাজ প্রাথমিকভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাজারজাত করবে। নিউ নরমাল সিচুয়েশনে এই জায়নামাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এবং ভবিষ্যতে এর বাজার আরো বড় হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

    দেশের বাজারে জায়নামাজঃ দেশের বাজারে দেশি জায়নামাজের চেয়ে বিদেশি জায়নামাজই পাওয়া যায় বেশি।বাংলাদেশে জায়নামাজ তৈরিতে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে।তুরস্ক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান এমনকি বেলজিয়ামের জায়নামাজও পাওয়া যায় বাংলাদেশে। রং-নকশায় বৈচিত্র্যপূর্ণ সব জায়নামাজ। কিনতে খরচ করতে হবে ৮৫০ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। দেশীয় জায়নামাজের দাম কিছুটা কম। দেশি একেকটি জায়নামাজের দাম পড়বে ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত। কাপড়ের কোমলতা আকার ও ডিজাইনের মানের কারণেই দাম কমবে বা বাড়বে।

    চলছে পবিত্র মাস মাহে রমজান।আর এই মাসে ধর্মপ্রান মুসল্লিদের অতি প্রয়োজনীয় একটি জিনিস হচ্ছে জায়নামাজ। এছাড়াও সামনে ঈদুল ফিতর এসময় বিশ্বব্যাপী  জায়নামাজ এর চাহিদা থাকে অনেক। সঠিক পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নিলে এই শিল্পে বাংলাদেশের রয়েছে অপার সম্ভাবনা।

    তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া, Nazmiyalantiquerugs, Nejad, Jagonews24, প্রথমআলো, ইউটিউব।

    Writer Information:

    Name:Mahafuz Islam Rahat
    Institute: Dr. M A Wazed Miah Textile Engineering College.
    Department: Yarn Engineering 
    Email LinkedIn

    Name: Al Wadud
    Institute: Dr. M A Wazed Miah Textile Engineering
    CollegeDepartment: Yarn Engineering 
    Email LinkedIn

    RELATED ARTICLES

    1 COMMENT

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    - Advertisment -

    Most Popular

    Recent Comments