Thursday, December 12, 2024
Magazine
More
    HomeJuteএকটি বাংলাদেশ আর পাটের গল্প

    একটি বাংলাদেশ আর পাটের গল্প

    ✅ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ‘সোনালী আশ’ খ্যাত পাট একসময় দেশের রপ্তানিতে মূল অবদান রাখতো। দেশে গার্মেন্টস শিল্পের যাত্রাকাল শুরুর প্রথম দিকেও রপ্তানিতে প্রায় এর অর্ধেকের অবদাব ই ছিলো পাট এর, বর্তমানে এই অবদান ৩-৪%।

    ১৫০ বছর পুরানো পাটশীল্প বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে ওতোপ্রোতো ভাবেই জড়িত। কিন্তু ঐতিহাসিক ও প্রচুর সম্ভবনাময় এই শিল্পকে আমরা যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারি নি। পাটকল গুলোতে প্রযুক্তির আধুনিকায়নের অভাবের পাশাপাশি সুষ্ঠু তদারকির অভাব,দূর্নীতি ও সম্ভবনা গুলোকে সঠিক কাজে লাগাতে না পারায় এই সেক্টরে ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে।সম্প্রতি রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫ টি পাটকলে শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক প্রদানের মাধ্যমে উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া হয়, যা এ শিল্পের অগ্রগতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

    এবার আলোচনায় আসা যাক পাটের কিছু সম্ভবনাময় ও লাভজনক ব্যবহার নিয়ে,

    ✅ পাট একটি ন্যাচারাল টেক্সটাইল ফাইবার। ট্রেডিশনাল,জিও ও এগ্রো টেক্সটাইলে পাটের অনেক সম্ভাবনাময় ব্যবহার রয়েছ।চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন পাট ও পাটশিল্পঃসংকট,সম্ভবনা ও উত্তরনের পথ শীর্ষক একটি আলোচনাসভায়বেশ কিছু পদক্ষেপ নিলে এসব পূরণ হওয়া সম্ভবঃ-

    • পাট উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে পাটচাষিদের মধ্যে উচ্চ ফলনশীল উন্নত জাতের বীজ সরবরাহ করা, গুণগত মানের পাট উৎপাদনে প্রণোদনা প্রদান এবং বাংলাদেশের ব্র্যান্ডকে টিকিয়ে রাখতে সরকারকে বিনিয়োগ করতে হবে,যার মাধ্যমে পাটকলগুলোয় সর্বশেষ আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজিত হলে পুরাতন পাটকলগুলো উন্নত কারখানায় পরিণত হবে। চাষিরাও পাটের ন্যায্যমূল্য পাবেন। ব্যাকোয়ার্ড লিংকেজ শিল্পও রক্ষা পাবে।
    • বিজেএমসিকে সংস্কার করতে হবে।
    • পাটের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগী একদল বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষকে ব্যবস্থাপনায় নিয়োগ দিতে হবে। করপোরেশনের ব্যবস্থাপনায় যাদের পাট ও পাটজাত বিষয়ের ওপর প্রয়োজনীয় জ্ঞান আছে সেসব বিজ্ঞানীকেও যুক্ত করতে হবে।
    • সরকারি খাতের পাটকলে দ্রুত শতবর্ষের পুরনো যন্ত্রপাতি সরিয়ে আধুনিক ও সর্বশেষ প্রযুক্তি সংবলিত মেশিন প্রতিস্থাপন করতে হবে। এতে উৎপাদনশীলতা বাড়বে।
    • পাটকলগুলোর প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার নিয়োজিত অতিরিক্ত জনবল কমাতে হবে।
    • আধুনিক ব্যবস্থাপনার উপযোগী জনবল তৈরিতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
    • দক্ষ ও প্রশিক্ষিতদের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ দিতে হবে।
    • পাট মৌসুম শুরুর পূর্বেই পাটকলগুলোকে কাঁচাপাট ক্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দিতে হবে।
    • পাট শিল্পকে কৃষিশিল্পের মতো সব সুযোগ সুবিধা দিতে হবে।
    • উৎপাদিত পাটপণ্য বাজারজাত করার লক্ষ্যে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে একটি বিশেষ পাট বিষয়ক ডেস্ক স্থাপন করতে হবে।
    • সরকারের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সব কার্যালয় ও সংস্থায় পাট ও পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে।
    • পাটপণ্য ব্যবহার সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
    • দুর্নীতিমুক্ত পাট প্রশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারকে আন্তরিক উদ্যোগ নিতে হবে।

    এই আলোচনা ও পাটের সার্বিক বহুমুখী ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করে বলা যায়:-

    📝 পাট এমনই একটি কৃষিপণ্য, যার কোনো কিছুই ফেলনা নয়। পাটের পাতা থেকে চা তৈরি করে তা বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব। পাটকাঠি জ্বালানি ও চারকোল তৈরি কাজে ব্যবহার করা হয়। পাটকাঠি পুড়িয়ে উৎপাদিত চারকোল থেকে প্রিন্টার মেশিনের কালি, ফেসওয়াশ, পানির ফিল্টার, বিষবিধ্বংসী ওষুধ ও জীবন রক্ষাকারী ওষুধ তৈরির কাজে ব্যবহারের জন্য বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।

    📝 সোনালী ব্যাগ:

    এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে দীর্ঘ গবেষণার পর বাংলাদেশে ২০১৮ সালে বিজ্ঞানী মোবারক আহমেদ খান পাট থেকে ‘সোনালী ব্যাগ’ বা পাটের তৈরি পলি ব্যাগ উদ্ভাবন করেন,যার বিশ্বব্যাপী অনেক চাহিদা রয়েছে।
    পাটজাত এ পলিথিন ব্যাগটি উৎপাদনে প্রথমে পাট থেকে সেসুলোজ সংগ্রহ করে সেটি প্রক্রিয়াজাত করা হয়। পরবর্তীতে সেলুলোজ থেকে সংগ্রহীত সিটের মাধ্যমে পলিথিন ব্যাগ তৈরি করা হয়।পাটের তৈরি সোনালী ব্যাগ সহজেই মাটির সাথে মিশে যায় এবং মাটিতে উর্বরতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

    এই ধরনের ব্যাগ বাজারের সাধারণ পলিথিনের ব্যাগের চেয়ে ১.৫ গুন শক্তিশালী। যুক্তরাজ্যের ‘ফুটামারা’ ক্যামিকালের সাথে এই ব্যাগের বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য চুক্তি করা হয়েছে।ইতিমধ্যে দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় একাধিক বার এই সোনালী ব্যাগ প্রদর্শিত হয়েছে, ১০ টাকা/পিস মূল্যে। বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হলে এই মূল্য আরো অনেক কমবে। বিশ্বব্যপী প্রতিবছর প্রায় ৫০০ বিলিয়ন শপিং ব্যাগের চাহিদা রয়েছে,সোনালী ব্যাগের বাণিজ্যিক উৎপাদন হলে এর একটি ক্ষুদ্র অংশ পূরণ সম্ভব। এছাড়া শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রতিদিন ৫০০ টন সোনালী ব্যাগ বাজারজাতকরণ সম্ভব। আবার বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ১৯ টি পণ্যে পাটের মোড়ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, এটি বাস্তবায়নে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করলে, দেশে প্রতি বছর ১০০ কোটি টাকার পাটপণ্যের চাহিদা সৃষ্টি হবে।

    📝 জিও-টেক্সটাইল হিসাবে পাট:

    পাট কাটিংস ও নিম্মমানের পাটের সঙ্গে নির্দিষ্ট অনুপাতে নারেকেলের ছোবড়ার সংমিশ্রণে প্রস্তুত পরিবেশবান্ধব ও ব্যয়সাশ্রয়ী জুট জিওটেক্সটাইল ভূমিক্ষয় রোধ, রাস্তা বেড়িবাঁধ নির্মাণ, নদীর পাড় রক্ষা ও পাহাড়ধস রোধে ব্যবহৃত হচ্ছে। জিওটেক্সটাইলের অভ্যন্তরীণ বাজারই এখন ৭০০ কোটি টাকার ওপর,এই খাতে আরো গবেষণা করা গেলে এই মার্কেট আরো ডেভেলোপ সম্ভব।

    📝 এপারেল টেক্সটাইলে পাট:

    পাট থেকে ভিসকস ইয়ার্ন তৈরি সম্ভব।এই ইয়ার্ন বা সুতার তৈরি পোশাক অনেক আরামদায়ক এবং অধিক দামের। দেশে প্রতি বছর গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে ৭০০-৯০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩০-৩৫ হাজার টন ভিসকস ইয়ার্ন আমদানি করা হয়। পাট থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিসকোস ইয়ার্ন প্রোডাকশন হলে এই আমদানির পরিমাণ কমানো সম্ভব।এসব ছাড়াও পাট দিয়ে শাড়ি, লুঙ্গি, সালোয়ার-কামিজ, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, বাহারি ব্যাগ, খেলনা, শোপিস, ওয়ালমেট, আলপনা, দৃশ্যাবলি, নকশিকাঁথা, পাপোশ, জুতা ,স্যান্ডেল, শিকা, দড়ি, সুতলি, দরজা-জানালার পর্দার কাপড়, গহনা ও গহনার বক্সসহ ২৭৫ ধরনের পণ্য দেশে-বিদেশে বাজারজাত করা হচ্ছে।

    সর্বোপরি বাংলাদেশে উৎপাদিত আর কোনো পণ্যর ই পাটের মতো এত বৃহৎ ব্যবহার সম্ভব নয়। অথচ এই পাট শীল্পর উন্নয়নের ব্যাপারে বরাবর ই অবহেলা দেখা যায়। সম্প্রতি রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫টি পাটকলের উৎপাদন বন্ধ ঘোষণা করে প্রায় ২৫হাজার স্থায়ী শ্রমিকদের প্রায় ৬হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক এর মাধ্যমে অবসরে পাঠানো হয়েছে। যা একই সাথে আরো ২৫ হাজার অস্থায়ী ও চুক্তিভিত্তিক পাট শ্রমিক এবং ৫০লাখ কৃষকের উপ বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করছে।

    অথচ দেশের পুরান প্রযুক্তির পাটকল গুলোর প্রযুক্তি আধুনিকায়নে “মাত্র ১২০০ কোটি টাকা” খরচ করলেই উৎপাদন ৩ গুণ বাড়ানো সম্ভব। এজন্য চীন থেকে ৩ হাজার আধুনিক উইভিং মেশিন বা তাঁত আমদানি করতে হবে।এতে করে দেশের আভ্যন্তরীণ চাহিদা ও রপ্তানি চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি শ্রমিকদের সকল বকেয়া পরিশোধ করলেও এই শীল্প থেকে আগের চেয়ে অনেক বেশি লাভ অর্জন করা সম্ভব। এর পাশাপাশি সোনালী ব্যাগের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর ব্যাপারে আরো তৎপর হলে, এবং পাটের ‘আরএন্ডডি’ (রিসার্চ এন্ড ডেভেলোপ) সেক্টর উন্নত করতে পারলে এই পাট শিল্প থেকে বাংলাদেশ আরো অনেক বেশি লাভবান হবে।

    ✒️ Writer information:

    Abdullah Mehedi Dipto
    Primeasia University
    Batch: 181
    Campus Core Team Member (TES)

    RELATED ARTICLES

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Related News

    - Advertisment -

    Most Viewed