Wednesday, April 24, 2024
More
    HomePrintingবাটিক শিল্পের ইতিকথা

    বাটিক শিল্পের ইতিকথা

    সুন্দরের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরন্তন। সেকারণেই মানুষ তা সৌন্দর্য বোধের প্রকাশ ঘটায় রং ও নকশার বিভিন্ন ব্যবহারের মাধ্যমে। রঙিন ও প্রিন্টের কাপড় এর মধ্যে অন্যতম। সুদূর অতীতে যখন কাপড় ছাপানোর যন্ত্র ছিলো না তখন মানুষ হাতেই নানাভাবে কাপড় প্রিন্ট করতো। যেমনঃ ব্লক, বাটিক, টাইডাই ইত্যাদি। সেই প্রাচীনকাল থেকে আজ অবধি এসব কাপড় ছাপানোর পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে।

    বাটিক প্রিন্টঃ কাপড়ের কিছু অংশে নকশা এঁকে তারপর নকশাটি মোম দিয়ে ঢেকে সেটা রঙে ডুবিয়ে যে পদ্ধতিতে কাপড় রং করা হয় তাকে বাটিক প্রিন্ট বলে। এক্ষেত্রে মোম লাগানো অংশে রং ঠিকমতো প্রবেশ করতে পারে না।ফলে তা অনবদ্য রুপ লাভ করে। বাটিক প্রিন্ট শুধু কাপড়েই নয়, চামড়ার উপরেও করা যায়।

    বাটিক ছাপার ইতিহাস ও উৎসঃ বাটিক ছাপার ইতিহাস সম্পর্কে সঠিকভাবে তেমন কিছু জানা যায়নি। তবে ধরে নেওয়া হয় যে, প্রাচ্য দেশসমূহ বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়ার জাভা, বালি ও তৎসংলগ্ন এলাকা গুলোতে প্রথম এই কাজের প্রচলন ঘটে। এমন ধারণার অন্যতম কারণ হলো, বাটিক শব্দটি ইন্দোনেশিয়ান ভাষা থেকে এসেছে। এই শব্দটি বাংলা করলে দাঁড়ায় একটি বিন্দু বা একটি ফোঁটা। বিন্দু বিন্দু মোমের সাহায্যেই ইন্দোনেশিয়ান বাটিক করা হতো। তবে এর উৎকর্ষ ঘটে ইন্দোনেশিয়া থেকে চীন দেশে সপ্তম শতাব্দীর প্রথম দিকে। এছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইউরোপের কিছু অংশ, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার কিছু অংশে বাটিকের কাজের প্রচলন দেখা যায়।
    বর্তমানে বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই বাটিক ছাপা ব্যাপকভাবে প্রচলিত এবং সর্বত্রই তা সমাদৃত। বাটিক অতি প্রাচীন একটি শিল্প। এ শিল্প প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরনো। গ্রীক সভ্যতাতেও বাটিক ছাপার কাপড় ব্যবহার হতো বলে নিদর্শন পাওয়া যায়। কেউ কেউ এই মতও প্রদান করেন প্রাচীন মিসরের অধিবাসীরাই এই শিল্পের পথিকৃৎ। এরপর বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে বাটিক শিল্প বিস্তার লাভ করেছে। তবে কাজের পদ্ধতিতে একটি দেশের থেকে অপর একটি দেশের কিছুটা পার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু মূল বিষয়বস্তু একই থাকে।তবে বাটিকের ক্ষেত্রে ভারতীয় মতটাই অধিক প্রচলিত। ভারতে বাটিক শিল্পের উৎপত্তি নিয়ে একটি গল্পও প্রচলিত রয়েছে –
    একদিন এক মহিলা পুকুর ঘাটে হরতকী গাছের নিচে তার পরিধানের বস্ত্র খুলে গোসল করতে পুকুরে নামেন। তিনি লক্ষ্য করেন যে, কিছু মৌমাছি তাঁর কাপড়ের উপর ঘুরে বেড়াচ্ছে। গোসল শেষে তিনি কাপড়টি পড়তে গিয়ে দেখলেন যে, কাপড়ের ওপরে মৌমাছিদের মোমের দাগ।তাই তিনি সেই কাপড়টি পরিষ্কার করার জন্য হরতকী গাছের ঠিক নিচেই পুকুরের পানিতে কাপড়টি ধোয়ার চেষ্টা করলেন।এতে দেখা গেলো যে, কাপড়ের যে জায়গা গুলোতে মৌমাছি দ্বারা মোম লেগে গিয়েছিলো সেই জায়গা গুলো সাদা রয়ে গেছে এবং বাকি জায়গা হরতকীর রঙে খাকি রং হয়ে গেছে। সাদা অংশ গুলোর জন্য কাপড়ে একধরনের নকশার সৃষ্টি হয়েছে। বলা হয়ে থাকে এ ঘটনার ফলেই ভারতীয় উপকূল অঞ্চলে সর্ব প্রথম বাটিক শিল্পের জন্ম হয়। বাংলাদেশে বাটিক হস্ত ও কারুশিল্প হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়। ষাটের দশকে গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ শিল্প বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।এর জনপ্রিয়তা ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে এখন পর্যন্ত সমান রয়েছে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে বাটিক শিল্পের যে চাহিদা রয়েছে, তার মূলে রয়েছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনিই ইংরেজ শাসনের শেষ দিকে বাঙালিদের এই শিল্পের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষন করতে সমর্থ হন। শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার পর কবি কায়কোবাদ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করেন। সেসব দেশের বাটিক শিল্প তাঁকে প্রভাবিত করে। তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর শান্তিনিকেতনে শিল্প ও কলা বিভাগে বাটিক শিল্প অবশ্য পাঠ্য করে দেন।

    বাটিকের প্রকারভেদঃ আমাদের দেশে নানা প্রকারের বাটিক দেখা যায়। যেমন:
    ★ মোম বাটিক
    ★ কুমিল্লা বাটিক
    ★ টাই ডাই বাটিক
    ★ চুনরি বাটিক
    ★ তুলি বাটিক
    ★ শিবুরি বাটিক ইত্যাদি।

    বাটিকের রংঃ বাটিকের রং হিসেবে প্রাকৃতিক ও রাসায়নিক দু ধরনের রংই ব্যবহার করা হয়। নীল, তুঁতে, গাঁদাফুল, শিউলীফুল,পেঁয়াজের খোসা,হরতকী, খয়ের ইত্যাদি প্রাকৃতিক উপাদান থেকে বিশেষ উপায়ে রং তৈরি করে তা দিয়ে বাটিকের কাজ করা হয়। আগে শুধু সুতি কাপড়েই বাটিক করা হতো কিন্তু এখন সুতির পাশাপাশি সিল্ক, গরদ, তসর, মসলিন অ্যান্ডিকটন এমনকি খাদি কাপড়েও বাটিক প্রিন্ট করা হয়। বর্তমানে বাটিক প্রিন্টের কাপড় খুবই জনপ্রিয়। বিশেষ করে হাল ফ্যাশনে বাটিক প্রিন্টের উপস্থিতি বেশ চোখে পড়ার মতো। বাটিক প্রিন্টের শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ-ওরনা, স্কার্ট, ফতুয়া, স্কার্ফ, শার্ট, পাঞ্জাবি ইত্যাদি সবই হয় দেখতে আকর্ষনীয়। ফলে তা আরামদায়ক ও ফ্যাশনেবল পোশাক হিসেবে সকলের মনে সহজেই স্হান করে নিয়েছে। বাটিকের গজ কাপড়ও পাওয়া যায় বেশ সুলভ মূল্যে। তাই গজ কাপড় কিনে অনেকেই বানিয়ে নেন নিজের পছন্দমতো পোশাক।
    বাটিকের শাড়ি যেমন পড়তে পারেন প্রতিদিনের প্রয়োজনে, তেমনি পড়তে পারেন উৎসব-অনুষ্ঠানেও। বিশেষ করে বাটিক প্রিন্টের সিল্কের শাড়ি আপনাকে করে তুলবে অতুলনীয়। সালোয়ার -কামিজ-ওরনাতে বাটিকের অনবদ্য কাজ পোশাকে এনে দেয় ঐতিহ্যের ছোঁয়া। জিন্স, লেগিংস বা জেনিংসের সাথে অনায়াসে পড়তে পারেন বাটিক প্রিন্টের ফতুয়া বা টপস্।সাথে থাকতে পারে বাটিক প্রিন্টেরই স্কার্ফ। বাটিক ছাপার স্কার্টের সাথে একরঙা টপস মানিয়ে যায় বেশ। ছেলেদের পোশাকের ক্ষেত্রেও বাটিক প্রিন্টের তুলনা নেই। বিশেষ করে পালা-পর্বনে বাটিকের পাঞ্জাবি যেন আবশ্যক। বাটিক প্রিন্টের শার্ট ও ফতুয়াও পোশাক হিসেবে তুলনাহীন। বিশেষ করে ক্যাজুয়াল বা সেমি-ক্যাজুয়াল হিসেবে বাটিক প্রিন্টের হাওয়াই শার্ট বেশ জনপ্রিয়।

    প্রাপ্তিস্হানঃ ক্রাফট সেন্টার, ফ্যাশন হাউজ গুলোতে বাটিকের গজ কাপড় বা পোশাক পাওয়া যায়। চরকা,সোর্স, গৃহসুখন, ওয়াইএমসিএ,আরণ্যক, প্রবর্তনাতে রয়েছে বাটিকের গজ কাপড় ও পোশাকের বিপুল সমাহার। এছাড়া গাউসিয়া,চাঁদনীচক, নিউমার্কেট সহ শহরের প্রায় সব মার্কেটেই বাটিক প্রিন্টের গজ কাপড় ও পোশাক পাওয়া যায়।

    দামদরঃ বাটিক প্রিন্টের কাপড়ের দাম নির্ভর করে এর রঙের ওপরে। কাপড়ে প্রাকৃতিক রঙের ব্যবহার হলে এর দাম তুলনামূলক ভাবে বেশি হয়। সালোয়ার-কামিজ (সেলাইবিহীন) পাবেন ৪৫০-২৫০০ টাকা, সেলাইসহ ১২০০-৪৫০০টাকা, ফতুয়া ৪৫০-১৫০০ টাকা, স্কার্ট ২৫০-১২০০ টাকা, ওরনা ৩৫০-১৫০০ টাকা, স্কার্ফ ১৫০-৫৫০ টাকা, পাঞ্জাবি ৬৫০-২০০০ টাকা, শার্ট ৪৫০-১২০০ টাকা। এছাড়া প্রতি গজ কাপড় পাবেন ১১০-৪৫০ এর মধ্যে।

    সঠিকভাবে এই শিল্পের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারলে দেশে ও দেশের বাইরে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।
    উৎসঃ প্রিয়.কম ও সমকাল।

    সাদিয়া তামান্না বিনতে তাইফুর
    ৪র্থ বর্ষ, ব্যাচ ২১
    বস্ত্রপরিচ্ছদ ও বয়নশিল্প বিভাগ
    বাংলাদেশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ।

    RELATED ARTICLES

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    - Advertisment -

    Most Popular

    Recent Comments