Thursday, April 18, 2024
More
    HomeTraditional Textile পর্ব-১০ঃ ঐতিহ্য আর আভিজাত্যের নকশিকাঁথা।

    [Traditional Textile Series] পর্ব-১০ঃ ঐতিহ্য আর আভিজাত্যের নকশিকাঁথা।


    ▪প্রাত্যহিক যান্ত্রিকতায় আর ব্যস্ততায় ভুলতে বসেছি আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের গৌরব। বিদেশীপণ্যের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশী পণ্য। আমাদের লোকশিল্প ও কারুশিল্প। মসলিন, জামদানি, শীতল পাটি, নকশিকাঁথার দেশের মানুষ হয়ে নিজেরাই নিজেদের ঐতিহ্য সম্পর্কে সঠিকভাবে জানি না। নকশিকাঁথা বাংলাদেশের লোকজীবনের তথা লোক-সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান হিসেবে আজও টিকে আছে। এটি বাংলার প্রাচীনতম লোক ঐতিহ্য। সূচিশিল্পের এ ঐতিহ্য অন্তত তিন হাজার বছরের পুরনো বলে ধারণা করা হয়। হৃদয়ের গভীরে লালিত সৌন্দর্য প্রিয়তাকে শৈল্পিকভাবে উপস্থাপনের মধ্যদিয়েই নকশিকাঁথা শিল্পের যাত্রা শুরু হয়।


    ▪সূচিশিল্পের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন নকশিকাঁথা। সাধারণ কাঁথার উপর বিভিন্ন ধরনের রঙিন সুতা দিয়ে নকশা তুলে যে বিশেষ ধরনের কাঁথা বানানো হয়, তাই নকশিকাঁথা। সাধারণত শাড়ি বা পুরাতন কাপড়ের পাড় থেকে রঙিন সুতা তুলে এই কাঁথা সেলাই করা হতো। রঙিন সুতা বাজারে সহজলভ্য হয়ে যাবার কারণে পরবর্তীতে পাড়ের সুতা ছাড়াও সেইসব রঙিন সুতা দিয়ে নকশিকাঁথা সেলাই করা শুরু হয়। প্রথমে সাধারণ কাঁথার মতোই নকশিকাঁথা ‘পাড়া’ হয় বা কয়েকস্তরের কাপড় দিয়ে কাঁথার জমিন সেলাই করে তৈরি করা হয়। তারপর সেই সাধারণ কাঁথার উপর রঙিন সুতা দিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে বিভিন্ন নকশা ফুটিয়ে তোলে নারীরা। ‘পাটি বা চাটাই ফোঁড়’ এবং ‘কাইত্যা ফোঁড়’ নামে সেলাইয়ের দু্টি ধরন নকশিকাঁথায় বিশেষ ব্যবহৃত হয়।


    যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নারীরা নকশিকাঁথা তৈরি করে চলেছেন। তবে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, জামালপুর, রংপুর, দিনাজপুর অঞ্চল নকশিকাঁথার জন্য বিখ্যাত। এছাড়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় নকশিকাঁথা তৈরি হয়। সাধারণত বর্ষাকালে যখন নারীদের হাতে খুব একটা কাজ থাকে না বা ঘরের বাইরের কাজ করার সুযোগ থাকে না, তখন নারীরা একা বা দল বেঁধে নকশিকাঁথা সেলাইয়ের কাজ করে থাকে। নকশিকাঁথা একান্তই নারীদের শিল্প।


    ▪মৃতপ্রায় গ্রামীণ লোকশিল্পের নাম নকশিকাঁথা। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটা গ্রামের একটি সাধারণ কুটিরশিল্প নকশিকাঁথা। গ্রামীণ নারীরা অবসরে পানের বাটাল নিয়ে নকশিকাঁথা বুনত। নকশিকাঁথার তৈরির অনন্য একটা সময় হল বর্ষাকাল। বর্ষাকালে যখন চারদিকে পানি থৈ থৈ করে তখন ঘরের বাইরে বের হওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার ছিল। তাই বাড়ির মেয়ে বৌরা সংসারের কাজ শেষে দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে পাটি বিছিয়ে পানের বাটাটি পাশে নিয়ে পা মেলে বসতেন এবং নকশা তোলা কাঁথা সেলাই করতে। পড়শিরাও সুযোগ পেলে আসত গল্প করতে। প্রায় ছয়মাস লেগে যেত একেকটা নকশিকাঁথা সেলাই করতে। আপন ভুবন রচনা করত নকশিকাঁথার জমিনে, নিজের সংসার, জীবন, কল্পনা আর ভালবাসার মানুষ থাকত দেই নকশিকাঁথায়। একেকটা ফোঁড়ের পেছনে থাকে কতনা গল্প, হাসি, কান্না।


    ▪নকশার সাথে মানানোর জন্য বা নতুন নকশার জন্য কাঁথার ফোঁড় ছোট বা বড় করা হয়। অর্থাৎ, ফোঁড়ের দৈর্ঘ্য ছোট বড় করে বৈচিত্র্য আনা হয়। কাঁথা ফোঁড়ের বৈচিত্র্যর জন্য এর দুটি নাম পাটি বা চাটাই ফোঁড় এবং কাইত্যা ফোঁড়। বেশির ভাগ গ্রামের নারী এই শিল্পে দক্ষ। সাধারণত গ্রামের মহিলারা তাদের অবসর সময় নকশিকাঁথা সেলাই করে থাকেন। এক একটি কাঁথা সেলাই করতে অনেক সময় এমনকি ১ বছরও সময় লেগে যায়। নতুন জামাইকে বা নাদ বউকে উপহার দেয়ার জন্য নানী-দাদীরা নকশিকাঁথা সেলাই করে থাকেন। এক একটি কাঁথা সেলাইয়ের পেছনে অনেক হাসি কান্নার কাহিনী থাকে। বিকেল বেলা রাতের খাবারের পর মহিলারা একসাথে গল্প করতে করতে এক একটি কাঁথা সেলাই করেন। তাই বলা হয় নকশিকাঁথা এক ধরণের মনের কথা বলে। এটি মূলত বর্ষাকালে সেলাই করা হয়। একটা প্রমান মাপের কাঁথা তৈরিতে ৫ থেকে ৭টা শাড়ি দরকার হয়।


    ▪নকশিকাঁথার কাজ ও ধরনের ভিত্তিতে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়ঃ
    সুজনীকাঁথাঃ এই কাঁথায় ঢেউ খেলানো ফুল ও লতাপাতার নকশা থাকে। কাঁথা বা খেতা সুজনী প্রধানত গ্রাম বাংলার (বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ) হাতে সেলাইয়ের কাজ করা আচ্ছাদন বস্ত্র। এটি কম্বলের তুলনায় পাতলা। সাধারণতঃ একাধিক শাড়িতে পরত দিয়ে কাঁথা তৈরি করা হয়। ফলে কাঁথা হয় মোলায়েম। এ কারণে এ কাঁথা ছোট বাচ্চাদেরকে কাঁথায় জড়িয়ে রাখা হয়। এ কাঁথার ঢেউ খেলানো ফুল ও লতাপাতার নকশার প্রাধান্য থাকে। 
    লহরীকাঁথাঃ পারস্য শব্দ লহর থেকে লহরীকাঁথা নামের উদ্ভব। লহর মানে ঢেউ। রাজশাহী অঞ্চলে এই কাঁথা বিখ্যাত।
    আনারসিঃ এ কাঁথা চাপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীতে পাওয়া যায়। এর প্রকারভেদ হলো আনারস টাইল, আনারস ঝুমকা ও আনারস লহরী।


    বাঁকা সেলাইঃ এই কাঁথা সবার প্রথম তৈরি হয় ব্রিটিশ আমলে। সাধারণতঃ এই কাঁথা বাঁকা সেলাইয়ের মাধ্যমে তৈরি করা হয়। সাধারণত কাঁথা কয়েক পাল্লা কাপড় কাঁথা ফোঁড়ে সেলাই করা হলেও এই ফোঁড় দেখার নৈপুণ্যের গুণে এতোই বিচিত্র বর্ণের নকশা বর্ণিল তরঙ্গঁ ও বরণভঙ্গির প্রকাশ ঘটে।
    গ্রাম-বাংলা চিরকালীন রূপ আর সেই বাংলার মানুষের হাতের কারুকার্য যেন একই মুদ্রার দুটো পিঠ, দুটি দিকই যেন পরস্পরের সাথে মিশে আছে পরম সৌন্দর্য নিয়ে। হোক সেটা নকশী কাঁথার মাঠে কিংবা হোক সেটা সোজন বাদিয়ার ঘাটে, হস্তশিল্পের আবেদন চিরকালীনই মিশে আছে বাংলাদেশের প্রকৃতি আর মানুষের সাথে। 


    Sajjadul Islam Rakib

    CA-Textile EngineersNITER (10th Batch)    

    RELATED ARTICLES

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    - Advertisment -

    Most Popular

    Recent Comments