Wednesday, April 24, 2024
More
    HomeTextile Manufacturingবিশ্বকবির স্মৃতিবিজড়িত “শাহজাদপুর হাট”

    বিশ্বকবির স্মৃতিবিজড়িত “শাহজাদপুর হাট”

    বাংলার নারীদের সৌন্দর্যের প্রতীক হলো শাড়ি। বিভিন্ন রঙ্গের শাড়ি যা বাংলার নারীদের ভূষণ। বাংলার নারীরা হলো শাড়িতে সুন্দর, আর শাড়ীকে টিকিয়ে রাখতে বাংলার কারিগররা বিভিন্ন ধরনের শাড়ি তৈরি করছেন তারমধ্যে তাঁতের শাড়ি অন্যতম। আর এই তাঁতের শাড়ির একটি অন্যতম হাট হলো শাহজাদপুর হাট। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর তাঁতশিল্পের একটি বিশাল বলয়। এ অঞ্চলে প্রায় পাঁচ লাখ তাঁতের শাড়ি , লুঙ্গি, ওড়না, গামছা তৈরি হয়। যার বাজার দেশে তো বটেই, ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও আছে। রোববার শাহজাদপুরে হাটের দিন। এটা পাঁচমিশালি হাট নয়, শাড়ির হাট।

    স্থানীয়দের মতে, দেশের সবচেয়ে বড় শাড়ির হাটটিই হলো এ শাহজাদপুরে। আশপাশের সোহাগপুর, এনায়েতপুর ও পাবনার আতাইকুলায়ও বসে শাড়ির হাট। শাহজাদপুরের এ হাটে হাতের তাঁত আর যান্ত্রিক তাঁতে (মেশিন লুম) তৈরি লুঙ্গি, থ্রি-পিস, ওড়না ও গামছা নিয়ে আসেন তাঁতি আর ব্যবসায়ীরা। শনিবার রাত থেকেই শুরু হয় তাদের আনাগোনা। রোববার ভোর থেকে শুরু হয় হাট। এরপর হাট বসে বুধবারে। এ হাট যেখানটায় বসে, সেটি হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের কাছারিবাড়ির দেয়াল সংলগ্ন জায়গা। শাহজাদপুর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত। সাধারণ লোকজনও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর কাছারিবাড়ির ব্যাপারে খুঁটিনাটি সব তথ্যই জানে।

    কাছারিবাড়ির সামনে থাকা দুটি তালগাছ দেখেই ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে…’ কবিতাটি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই জোড়া তালগাছ এখনো এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে। বয়স সার্ধশত বছরেরও বেশি। সেই সময়ের নিমগাছটাও আছে এখন। শাহজাদপুর ঘেঁষে বয়ে গেছে করতোয়া নদী। করতোয়ার একটা শাখা যুক্ত হয়েছিল বড়াল নদীর সঙ্গে। এই শাখা নদী কুঠিবাড়ির সামনে দিয়েই বহমান ছিল। সেটি এখন ভরাট। এ নদী দেখেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।’ কাছারিবাড়িটি ১৯৬৯ সাল থেকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সংরক্ষণ করছে। এটা একসময় ছিল নাটোরের রানি ভবানীর জমিদারির একটি অংশ। ১৮৪০ সালে শাহজাদপুরে রানি ভবানীর জমিদারি নিলামে উঠলে বিশ্ব কবির পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর মাত্র ১৩ টাকা ১০ আনায় তা কিনে নিয়েছিলেন।

    ১৮৯০ থেকে ১৮৯৭ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাঝে মধ্যে জমিদারি দেখতে আসতেন এবং থাকতেন। আগের দোতলা কাছারিবাড়িটাকেই সংরক্ষণ করা হয়েছে। দোতলায় রবীন্দ্র স্মৃতিজাদুঘর। এখানে কবির ব্যবহৃত খাট, সোফা, টেবিল-চেয়ার, টেবিল বেসিন, বাসনকোসন ইত্যাদি রয়েছে। রোববার বাদে এ জাদুঘর খোলা থাকে দর্শকদের জন্য। কাছারিবাড়ির প্রাঙ্গণে নতুন করে একটি মিলনায়তন তৈরি করা হয়েছে। আবার ফিরে আসা যাক হাটে। শাড়ির রঙে, নকশায় এ হাট যেন বাণিজ্যের রঙিন এক ভুবন। প্রতিটি হাটে প্রায় ১০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়। ৩০০ থেকে শুরু করে তিন হাজার টাকা জোড়া দামের শাড়ি বিক্রি হয় এ হাটে। সারাদেশ থেকেই ক্রেতারা আসেন এখানে।

    হাট ঘুরে দেখা গেল, শাড়ির পাশাপাশি লুঙ্গি, ওড়না ও গামছার সংখ্যাও কম নয়। হাটের পাশে কাছারিবাড়ি রোডে আছে সুতার মার্কেট। রং-সুতা বিক্রি হয় এখানে। নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের বিভিন্ন মিলে তৈরি হয় এসব সুতা। সেখান থেকে আসে এখানে। এরপর তাঁতিরা কিনে নেন। গোটা শাহজাদপুরেই তাঁতের খটখট আওয়াজ। ঘুরে ঘুরে দেখা হয় কাপড় তৈরির প্রক্রিয়াগুলো। সুতা কিনে তা নানা রঙে রাঙানো হয়। ডাই করার কাজটি চলে হাতে হাতেই। এরপর শুকানোর পালা। ছোট ছোট ববিনে ভরা হয়। তারপর কাপড়ের জমিনের নকশা অনুযায়ী সুতা সাজানো হয় ড্রামে। অনেক জায়গায় ‘টানা’ দিয়ে এ কাজটা করা হয়।

    কিন্তু শাহজাদপুরে বেশি কাপড় তৈরি করতে হয় বলে ড্রামপদ্ধতি সহজ। ড্রামে ৪৮ ইঞ্চি প্রস্থজুড়ে সাজানো হয় সুতা । এরপর চলে যায় তাঁতে। সেখানে বুননের মধ্যেই ফুটে ওঠে নকশা। তৈরি হওয়ার পর কাপড়ের প্রস্থ দাঁড়ায় ৪৬ ইঞ্চিতে। তাঁতিরা জানান, এ অঞ্চলে চিত্তরঞ্জন তাঁত আর পিটলুমের ব্যবহার বেশি। কাপড়ে সুতার নকশা ফুটিয়ে তুলতে ‘জ্যাকার্ড’ পদ্ধতিই চলছে। বাড়ি বাড়ি তাঁতের খটখট শব্দ, রঙের গন্ধ নাকে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে একবার ইচ্ছা করে করতোয়ার পাড়ে যেতে।

    নদীভাঙন থেকে শাহজাদপুরকে বাঁচাতে এখানে বাঁধ দেয়া হয়েছে। বাঁধের পাড়েই বটগাছ। তার নিচে বসার জায়গা। আর এর পাশেই হজরত মখদুম শাহ দৌলা শহীদ ইয়ামেনীর (রহ.) মাজার। সাড়ে ৭০০ বছর আগে তিনি ইয়েমেন থেকে এসেছিলেন এ অঞ্চলে।এ থেকে বোঝা যাচ্ছে শাহজাদপুর হাট হল ঐতিহ্যবাহী হাট। অনেক আগে থেকেই হাটে বিভিন্ন ধরনের তাঁতের রপ্তানি হচ্ছে। দেশ-বিদেশের লোক শাহজাদপুর হাটে এসে কাপড় আমদানি করছেন। যা থেকে আমাদের অনেক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হচ্ছে। যা আমাদের প্রাকৃতিক ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হচ্ছে।

    এছাড়া বাঙালি জাতির একটি রহস্যময় ইতিহাস টিকিয়ে রাখছে এই তাঁত শিল্প। শুধু তাই নয়, এই কাপড়ের হাটের খাতিরে শাহজাদপুরে কোনো প্রকার হরতাল-ধর্মঘট পর্যন্ত হয় না। সারাদেশ যখন হরতালে অচল থাকে তখনও শাহজাদপুরের কাপড়ের হাট স্বগৌরবে স্বাভাবিকভাবে চলে। এছাড়াও, শাহজাদপুরে পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক-এমন কি রাজনৈতিক উৎসব অনুষ্ঠানের কর্মসূচিও হাটের দিন বাদ দিয়ে করা হয়ে থাকে। সত্য কথা বলতে কি, শাহজাদপুরের সামগ্রিক জীবনধারা অনেকাংশে এই হাটের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

    শাহজাদপুরের কাপড়ের হাট যেন এখানকার ধমনিতে রক্ত প্রবাহের মতো অনিবার্য এবং গুরুত্বপূর্ন। বলা হয়ে থাকে এই হাটে যে বিপুল পরিমান কাপড় আমদানি হয় তার শতকরা ৬০ ভাগ ভারতের ব্যবসয়ীরা কিনে নিয়ে যান। উল্লেখ্য, এতোদিন শুধু ভারত থেকে আমাদের দেশে কাপড় এসেছে। কিন্তু শাহজাদপুরের কাপড়ের গুনগত মানের কারনে শাহজাদপুর হাট থেকেই প্রচুর পরিমানে কাপড় ভারতে চলে যাচ্ছে। এটি শাহজাদপুর কাপড়ের হাটের একটি গৌরবের বিষয়। শাহজাদপুরের কাপড়ের হাটটি একটি দর্শনীয় বিষয়ও বটে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বহু লোক এ হাট দেখতে আসে। তাই হাটটি শাহজাদপুরে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ বিষয়।

    তথ্যসূত্র: প্রথম আলো, Google

    Writer information:

    Antor Saha
    Department Of Textile Engineering,
    BGMEA University Of Fashion & Technology (BUFT)

    RELATED ARTICLES

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    - Advertisment -

    Most Popular

    Recent Comments